![]()
আটত্রিশ বছরের জীবনের শেষ দশ বছরই তার হাতে তুলি–রং–ইজেল–ক্যানভাস মুখরিত হয়েছিল। কারও কাছে আঁকা শেখেননি, নিজে নিজেই ক্যানভাসে তুলি বুলিয়ে একের পর এক কালজয়ী সব ছবি এঁকেছেন। শুধু তো রাত নয়, দিনে সূর্যের আলোয় তার আঁকা প্রসঙ্গে নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘যখন তিনি সূর্যের প্রতিকৃতি আঁকেন, তখন মানুষকে তিনি বোঝাতে চান সূর্য প্রবলগতিতে তার কক্ষপথ আবর্তন করছে। যখন ফসলের মাঠ আঁকেন তখন আসলে শস্যের বীজ উদ্গিরণের দৃশ্যকে আঁকতে চান। সাইপ্রাস গাছ তার ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটায়। সবকিছু জ্বলেপুড়ে যেতে থাকে।’ যদিও তিনি আকাশ এঁকেছেন, ফুল এঁকেছেন, নারী এঁকেছেন বা পাখির ঝাঁক কিংবা স্বপ্নিল মাছ, আশ্চর্য নক্ষত্রপুঞ্জ অথবা ঘূর্ণায়মান আলোকরশ্মির উজ্জ্বল প্রগলভতা। তার রঙিন ক্যানভাসে সবকিছুতে নতুন একটা বর্ণচৈতন্যের সন্ধান পেয়েছে মানুষ। এসবই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিলাম সেবার আমস্টারডামে ভ্যান গখ শিল্প–মন্দিরে ঢুকে। এমন রং আর কোথাও দেখা যায় না। কোথাও হয়তো আর দেখাও যাবে না। অবাক বিস্ময়ে সেই সমস্ত কালজয়ী পেইন্টিং দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ–এর মতো মহান রৌদ্রদগ্ধ চিত্রকর দুনিয়ায় আর দুটি নেই। তাই আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন তিনি! অথচ ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই এই ভ্যান গখই কিন্তু জীবনকে মৃত্যুর কাছে বাজি রেখেছিলেন। সেদিন ছোট্ট গুলিভর্তি একটি ল্যফ্যঁশো [Lefaucheux] রিভলভার তুলে নিয়েছিলেন হাতে। তারপর ট্রিগারে হাত রেখে চাপ দিলেন। ব্যস, পরের ঘটনাটি মর্মান্তিক। সারা পৃথিবীর কাছে খবর পৌঁছে গেল ভ্যান গখ নিজের জীবনকে মৃত্যুর কোলে সঁপে দিয়েছেন। যদিও মাঝের এই দীর্ঘ সময়ে বহুবার তার মৃত্যু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে নানা মহল থেকে। সন্দেহ হয়েছে বিশেষজ্ঞদের, এ মৃত্যু কি সত্যিই আত্মহনন? তবে অধিকাংশেরই মত, তিনি নিজেই নিজের বুকে গুলি করেছিলেন। ২০১৬ সালে যখন আমস্টারডামের ভ্যান গখ মিউজিয়ামে যাই, তখন অল্প কিছুদিনের জন্য এই ঐতিহাসিক ঘাতক রিভলভারটি সেখানে প্রদর্শিত হয়েছিল। পরে তার দুনিয়া কাঁপানো ছবির পাশে ঘাতক রিভলভারটির প্রদর্শনের তীব্র সমালোচনা হয়। ফলে তা অল্প কিছুদিন পরই সরিয়ে নেওয়া হয়। অতি সম্প্রতি তার ব্যবহৃত সেই কুখ্যাত মরচে পড়া রিভলভারটিকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। কেন সেই অস্ত্রটি ফের সংবাদের শিরোনামে এলো? আসলে প্যারিসের অকশন আর্ট নামে একটি সংস্থা এটিকে নিলামে তুলেছে। দাম উঠেছে ১৬২,৫০০ ইউরো। যথারীতি জং ধরা সওয়া শো বছরের পুরোনো রিভলভারটি বিক্রিও হয়ে গেছে। কিন্তু কে কিনেছেন তার নাম গোপন রাখা হয়েছে। এখন খুবই সঙ্গত কারণে মনে হতে পারে, এত বড় মাপের শিল্পী কেন অমন করে নিজের জীবনের দীপটি পিস্তলের গুলির কাছে সঁপে দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে দেখতে হবে তার বর্ণময় জীবনের ইতিহাস। ভাবা যায়, এই পৃথিবীখ্যাত শিল্পীর আঁকা মাত্র একটি ছবি তার জীবৎকালে খদ্দের পেয়েছিল! ছেলেবেলায় কখনও ছবি আঁকায় তার আগ্রহের কথা জানা যায় না। বয়স যখন ২৮, ভিনসেন্ট আঁকাআঁকি শুরু করলেন। সবে আঁকা শিখছেন। তাই পেন্সিল স্কেচ থেকে কয়লার কাজ, ছোট ছোট অয়েল পেইন্টিং করছেন। হাত পাকাচ্ছেন। সংসারে তার আঁকার ব্যাপারে শুধুমাত্র ছোট ভাই থিওরই সমর্থন ছিল। থিওকে নানা সময়ে নানা প্রসঙ্গে চিঠি লিখেছেন তার বড় ভাই। ‘ভাই থিও, আমি কৃষকের ছবি আঁকার চেষ্টা করছি, আজীবন কঠোর পরিশ্রমে ন্যূব্জ দেখাতে চাই, কিন্তু একদমই হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ৫০-বার স্কেচ করেছি, দরকার হলে ১০০-বার করব, কিন্তু যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে চাই, ঠিক সেভাবে না হওয়া পর্যন্ত থামব না পণ করেছি।’ এমন করেই দশটা বছর তিনি আঁকতে চেয়েছিলেন। না, কোনো প্রথাগত আর্ট কলেজের শিক্ষা তিনি পাননি, কোনো আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসও কোথাও করেননি। তেমন কোনো শিক্ষকের ছায়াও পাননি। শিখেছেন নিজে, বই পড়ে, আঁকতে আঁকতে। সঙ্গে প্রচুর বইও পড়েছেন। ডাচ, ফরাসি, ইংরেজি এবং জার্মান ভাষার বই নিয়মিত পড়তেন। বেলজিয়াম সীমান্তবর্তী নেদারল্যান্ডসের একটি গ্রাম, জুনজার্ট। ১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ এখানে ভ্যান গখ জন্মেছিলেন। গখের পাদ্রি বা যাজক বাবা–মা থিওডর এবং কর্নোলিয়ার প্রথম সন্তানটি মৃত জন্মেছিল। ঠিক তার এক বছর পর একই দিনে ভিনসেন্ট জন্মান। কিন্তু তার পিতা–মাতা প্রথম সন্তানের বিষাদঘন স্মৃতি ভুলতে না পেরে সেই মৃত ছেলের নামেই নামকরণ করেন ভিনসেন্টের। আবির্ভাবেই মৃত ভাইয়ের নাম তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। বাড়ির প্রাঙ্গণেই মৃত ভাইটির সমাধি ছিল, ফলে সেই সমাধির স্মৃতি নিয়েই তার শৈশব কাটে। এরপর তাদের পরিবারে আরও চারটি শিশু আসে। ভিনসেন্টরা দুই ভাই এবং তিন বোন। ভিনসেন্ট বরাবরই একটু ভিন্ন প্রকৃতির। তার ভাইবোনেরা যখন খেলাধুলা করত জুনডার্টের প্রকৃতির কোলে তখন সে একা একাই ঘুরে বেড়াত। কোনো বন্ধুবান্ধবের কথাও জানা যায় না। কৈশোর বয়সেই ভিনসেন্টের আঁকায় হাতেখড়ি। একা একাই পেন্সিল ড্রইং করত সে। তার বাবার এক ভাইয়ের একটি স্টুডিও ছিল, তিনি আর্টের কারবারি ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে ভিনসেন্ট সেই কাকার গোপিল অ্যান্ড কোম্পানিতে চাকরিতে যোগ দিলেন। প্রায় চার বছর সেখানে চাকরি করার পর ১৮৭৪ সালে লন্ডনে বদলি হয়ে যান। তখন তিনি ২২ বছরের যুবক। লন্ডনে যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ির মালিকের মেয়ের প্রেমে পড়েন। চলে নানা টানাপোড়েন। কাজে আর মন বসে না। এদিকে প্রেমে পড়লে কী হবে, চাকরি না থাকলে যে দূরদেশে প্রেমের কোনো মাহাত্ম্যই নেই। এমতাবস্থায় তার চাকরি যায় চলে। চূড়ান্ত ব্যর্থতা তাকে গ্রাস করতে থাকে। লন্ডনের স্মৃতিও তিনি ভুলতে পারেন না। থেকে থেকে ডুকরে ওঠেন। দু’বছর যেতে না যেতেই ১৮৭৬ সালে ফের লন্ডনে ছুটলেন। এবারে একটি স্কুলের সহকারীর পদে যোগ দিলেন ভিনসেন্ট। কয়েকদিন পর ভিনসেন্টের ওপর দায়িত্ব চাপে দরিদ্র ছাত্রদের বকেয়া ফি আদায়ের। সেই সময় তার জীবনের পাঠ শুরু হয়। কাছ থেকে অভাবকে দেখেন। বকেয়া আদায়ের পরিবর্তে তার মন কেঁদে ওঠে। তিনি দরিদ্র পরিবারগুলিকে সাহায্যের জন্য সহযোগিতা করতে শুরু করেন। আবার কোপ পড়ে চাকরিতে। সামাজিক এই বৈষম্য দেখে ভেঙে পড়েন। ফিরে আসেন দেশে। বাবার সহকারী হতে চান। কিন্তু পাদ্রি হতে গেলে যে বিপুল পরিমাণে ধর্মীয় পড়াশোনা করা দরকার। ভিনসেন্ট কী তা করবেন, বাবা–মায়ের সন্দেহ হয়। ভিনসেন্ট শুরু করলেন তেজ নিয়ে কিন্তু একটি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মন গেল ছুটে। চলে গেলেন বেলজিয়ামে। সেখানকার একটি কয়লাখনিতে পাদ্রির কাজে যোগ দিলেন। কিন্তু তা হয় কখনও। নিজের জামাকাপড় পর্যন্ত খুলে দান করে দিতেন কয়লাখনির মজুরদের। খোয়াতে হল পাদ্রির চাকরিটিও। না এবারে দেশে ফিরে আসেননি। দু’বছর ওই বোর্নিয়াজ শহরের কয়লাখনির শ্রমিকদের সঙ্গেই ভয়ানক অভাবের মধ্যে কাটালেন। তখন শুরু করলেন কয়লাখনির শ্রমিকদের ছবি আঁকা। সিদ্ধান্ত নিলেন এবারে ছবি আঁকাতেই পুরো মন দেবেন। দু’বছর কাটার পর দেশে ফিরলেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পরও দেখা গেল ছবি আঁকাই তার ধ্যানজ্ঞান। চুটিয়ে ছবি আঁকতে লেগে গেলেন। সে এক অনাবিল আনন্দের ধারা। ভাইকে চিঠিতে নিজের সন্তুষ্টি আর সিদ্ধান্তের কথা জানালেন—‘অবশেষে আমি আমার জীবনের চরমতম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমি শিল্পী হব, আর কিছু নয়। আমি নিজেকে বললাম, চরম হতাশায় যে পেন্সিলটিকে নামিয়ে রেখেছিলাম, তা আবার হাতে তুলে নিলাম এবং শিল্প সৃষ্টিতেই নিবেদিত করলাম নিজেকে। মুহূর্তের মধ্যে যেন আমার চারপাশ রূপান্তরিত হলো।’ এই খুশির সিদ্ধান্তে সকলেই খুশি। বেশ কিছুদিন চললও এমন করে। তা এমন বাধাহীন, দ্বিধাহীন, দ্বন্দ্বহীন, প্রেমহীন জীবন কি তার মতো বাউন্ডুলে চিত্রকরের মানায়! না, মানাল না। তিনি আবার প্রেমে পড়লেন। এবং এবারও ব্যর্থ হলেন প্রেমে। অস্থিরতা তখন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। বাবার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তার গোল বাধল। তুমুল ঝগড়ার জেরে ১৮৮১ সালে ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে, ক্রিসমাসে বাড়ি ত্যাগ করলেন। চলে গেলেন হাগে। তখন তিনি একেবারেই নিঃস্ব। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। এদিকে নত হওয়ার মানুষ তিনি নন। সাহায্য চাওয়াও তার কাছে অপরাধসম। এমন অসহায় মুহূর্তে ঠিক করলেন ভাই থিওকে চিঠি লেখা যেতে পারে। থিওকে লেখেন, তার সংসার ঠিকমতো চালানোর পর যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে, তবে ইচ্ছে হলে তা যেন ভিনসেন্টকে দান করতে পারে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার, ভ্যান গখের এই ভাইটি কতভাবেই যে ভিনসেন্টকে সারাজীবন দেখেছেন, তা বলার নয়। যাই হোক, থিও প্রতি মাসে ভিনসেন্টকে টাকা পাঠাতে থাকলেন। ভিনসেন্ট আবার কাজে লেগে পড়লেন। হাগের নৈসর্গিক দৃশ্য একের পর এক এঁকে ক্যানভাস ভরিয়ে তুললেন। তার জীবনে আবার নারী এলো, একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। এদিকে ভাই থিও যখন জানতে পারলেন সেই নারী পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত ভিনসেন্টকে নিষেধ করলেন বিয়ে করতে। বিয়ে ভেঙে গেল। ফিরে এলোেন দেশে। এমন একটি বর্ণময় জীবন কাহিনির গল্প পড়ে শুনে মনে হতেই পারে শিল্পী ভ্যান গখ কত না টালমাটাল হয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে এলোে কী হবে, এক বছরের মাথায় বাবা মারা গেলেন। আবার দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। এই তার শেষ দেশ ছাড়া। প্রথমে বেলজিয়াম, পরে ফ্রান্সে গেলেন। প্যারিসে ভাই থিও’র ছোট্ট কুঠিতে ঠাঁই নিলেন। প্যারিসে তার চিত্রখ্যাতির পাশাপাশি সহশিল্পীদের হিংসা, ঈর্ষা তাকে মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত করে দিল। যে কিনা কোনোদিন কোনো নেশায় আসক্ত ছিল না, সে তখন সব ভুলতে আকণ্ঠ মদ গিলতে শুরু করল। এতটাই বিষণ্ণ, বিপন্নবোধ করলেন যে ভাই থিওর সঙ্গেও তুমুল ঝগড়া করতে লাগলেন। ১৮৮৮ সালে চলে গেলেন দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্ল শহরে। জায়গাটি তার মনে ধরে গেল। একটি হলুদ রঙের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। কিন্তু মন তাকে ধরে রাখতে দিলে তো। একদিন পল গগ্যাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন। গগ্যাঁ যাওয়া–আসা থাকা–খাওয়ার শর্তসাপেক্ষে এলোেন গখের ছবি দেখতে। গগ্যাঁ দেখলেন গখের এক পতিতা–মডেলের ছবি, যাকে গগ্যাঁ নিজেও খুব প্রশ্রয় দেন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ‘এক ফুল দো মালি’র গল্প! গখ মদের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন গগ্যাঁকে। তারপর ক্ষুর নিয়ে তেড়ে গেলেন গগ্যাঁকে মারতে। না মারতে পারার খেদ নিয়ে শেষে নিজেই নিজের ডান কানের লতিটি কেটে ক্রিসমাসের উপহার হিসেবে বান্ধবী সেই পতিতা মডেলের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বান্ধবী নাকি একবার তার কানের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছিলেন। এদিকে কান কেটে ফেলার পর গখ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শরীরে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। তিনি মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। হাসপাতালে দু’সপ্তাহ তার রোগের চিকিৎসা চলার পর ছাড়া পান। আবার কাজে ফেরেন। পাগলের মতো দিনরাত ছবি আঁকতে থাকেন। পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ভর্তি করানো হল হাসপাতালে। চিকিৎসা চলল বেশ কিছুদিন। একটু সুস্থতাবোধ করছেন যখন তখন হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে সিদ্ধান্ত হল। এই সময় আবার তার জীবনে অন্য একটি সমস্যা ঘনিয়ে এলো। আর্ল শহরের প্রায় শখানেক বিশিষ্ট নাগরিক নগরপালিকার কাছে লিখিত আবেদন জানাল যে, ভিনসেন্ট ভ্যান গখের মতো উন্মাদকে যেন এই শহরে আর ঠাঁই না দেওয়া হয়। হলও তাই। ‘হলুদ বাড়ি’তে থাকার রঙিন স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। আর্ল ছেড়ে সেন্ট রেমির একটি মানসিক চিকিৎসা–কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেন। এই চিকিৎসা–কেন্দ্রে থাকাকালীন তিনি প্রায় ২০০টি ক্যানভাসে ছবি এঁকেছিলেন। এই সময়েই অর্থাৎ ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসে এক প্রদর্শনীতে ‘আর্লের আঙুর খেত’ নামের ছবিটি ৪০০ ফ্রাঁ–তে বিক্রি হয়। এটিই তার জীবদ্দশায় বিক্রি হওয়া একমাত্র ছবি। ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন তিনি। এবারে ছাড়া পেয়ে চলে গেলেন প্যারিসের উত্তর–পশ্চিমে অ্যাভঁরো গ্রামে। তার জন্যে একটি ক্যাফেতে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিলেন থিও। থিও’র নিজেরই তখন আর্থিক সঙ্কট চলছে। এদিকে গখের খরচ বাড়ছে। কী হবে পরিণতি। ভাবতে ভাবতে আবার হতাশা গ্রাস করতে লাগল ভিনসেন্টকে। ১৮৯০। ৩৭ বছর বয়স। ভিনসেন্ট ভ্যান গখ জুলাই মাসের ২৭ তারিখে সেই অ্যাভঁরোর গ্রাম্য মেঠো আল পথ ধরে চলেছেন। সন্ধে নেমে এসেছে। রাতে ফিরলেন, শান্ত চারিদিক। কিছু খেলেন না। বিছানায় শুলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার উঠে পড়লেন। পায়চারি করলেন ছোট ঘরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। তারপর ড্রয়ার খুললেন, সেখানে স্থানীয় এক সরাইখানার মালিকের থেকে নিয়ে আসা ছোট্ট একটি রিভলভার রাখা ছিল। বের করলেন। তারপর ট্রিগারে আঙুল রেখে চাপ দিলেন। ছিটকে বেরিয়ে আসা বুলেট তার বুক ফুঁড়ে ঢুকে গেল। কাতরাতে কাতরাতে পাইপে টান দিতে দিতে বিছানায় শুয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন। সারারাত এমন ভাবে কাটার পর সকালে ভাই এলেন, ডাক্তার এলেন। ‘কেন এমন করলে?’ সকলে তাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলেন ‘এটা আমার দেহ। আমি যা খুশি করতে পারি তা নিয়ে, কাউকে দোষ তো দিচ্ছি না, আমার ইচ্ছে আত্মহত্যা করি। তাই করেছি।’ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও কিন্তু শেষরক্ষা হল না। চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। যদিও সাম্প্রতিককালে কিছু গবেষকের দাবি ভ্যান গখ আত্মহত্যা করেননি। রিভলভার নিয়ে স্থানীয় দুটি বালক খেলতে খেলতে আচমকাই রিভলভার থেকে ছুটে আসা গুলি গখের বুকে গিয়ে বেঁধে। এবং তাতেই তিনি দুদিন পর মারা যান। আবার প্যারিসের অকশন আর্ট দাবি করেছে এই রিভলভার বুকে ঠেকিয়েই আত্মহত্যা করেছিলেন ভ্যান গখ। প্যারিসের উত্তর সীমান্তে যে গ্রামের বাড়িতে তিনি গুলি চালিয়েছিলেন নিজের বুকে, সেখানেই দীর্ঘ বছর মানুষের চোখের আড়ালে পড়েছিল ৭ মিমি ল্যফ্যঁশো [Lefaucheux] এই রিভলভারটি। সেই আমলে এই রিভলভারটির চল ছিল। তবে তা আত্মরক্ষার জন্যই কাছে রাখা হত। পরে ১৯৬৫ সাল নাগাদ স্থানীয় একটি খেতে এক কৃষক সেটি কুড়িয়ে পান। তিনি সেটি গ্রামের এক প্রধানের হাতে তুলে দেন। সেখান থেকে নানা হাত ঘুরে পৌঁছোয় অকশন আর্টের দোকানে। যদিও অনেকেই এই রিভলভারের আসল মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আবার কারওর দাবি আমস্টারডামের ভ্যান গখ মিউজিয়ামে যে রিভলভার রাখা ছিল, তার সঙ্গে এর বিস্তর মিল। তবে নানাবিধ জল্পনা–কল্পনা, তর্ক–বিতর্ক, দ্বিধা–দ্বন্দ্বের মাঝেই অকশন আর্ট সম্প্রতি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘১৮৯০ সালে যে রিভলভারটি দিয়ে ভ্যান গখ আত্মহত্যা করেছিলেন, সেটির সঙ্গে এই রিভলভারের অনেক মিল রয়েছে। সেই সময় যে ডাক্তার শিল্পীর মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন তিনি গুলি ও পিস্তলের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার প্রায় সবই মিলে যায় এই রিভলভারের সঙ্গে।’ বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলেছেন, নিলামে ওঠা এই রিভলভার মাটিতে পড়েছিল প্রায় পাঁচ থেকে আট দশক। তবে রিভলভারটি এমনভাবে নিলামে বিক্রি হওয়াকে আমস্টারডমের ভ্যান গখ মিউজিয়াম ভাল চোখে দেখছে না। শিল্পীর জীবনের সঙ্গে এক দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী–সহ নিলামে চড়িয়ে ব্যবসা না হলেই বোধহয় ভাল হত বলে তারা জানায়। |