শনিবার ৮ নভেম্বর ২০২৫ ২৪ কার্তিক ১৪৩২
শনিবার ৮ নভেম্বর ২০২৫
 
মতামত
ডাকসুর লড়াই নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক দ্রোহ





সরদার ফরিদ আহমদ
Saturday, 8 November, 2025
1:49 PM
Update: 08.11.2025
1:50:53 PM
 @palabadalnet

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের পাদপীঠ, চিন্তার কেন্দ্র এবং তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে গৌরবময় প্রতিষ্ঠানটি এক অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতার সাথে লড়ছিল। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক ও নিরাপত্তাহীনতার কালো ছায়া একে ঘিরে ছিল। একসময় এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মুক্তচিন্তার সুতিকাগার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা পরিণত হয়েছিল ভয় আর আতঙ্কের জায়গায়। এ অবস্থায় ডাকসুর সাম্প্রতিক উদ্যোগ-চাঁদাবাজমুক্ত, নিরাপদ, মাদকমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যাম্পাসে এক নবজাগরণের সূচনা করেছে।

ডাকসুর নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের এক অভূতপূর্ব সাড়া দেখা যাচ্ছে। এ অভিযানে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, রয়েছে এক নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বার্তা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, প্রতিটি হল, করিডোরে চলছে চাঁদাবাজি ও মাদকবিরোধী অভিযান। ডাকসুকে শিক্ষার্থীরা এখন নিজেদের ভরসাস্থল মনে করছেন। বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে দেখা গেছে স্বস্তি ও আশার প্রতিফলন। ‘এখন রাতে লাইব্রেরি থেকে ফিরতে ভয় লাগে না’-এই একটি মন্তব্যে যেন গোটা পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে।

ডাকসুর এ অভিযান ঘিরে কিছু বামপন্থী ব্যক্তি ও মিডিয়ার সমালোচনা শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, এটি জনতুষ্টিবাদী প্রদর্শনী, কেউ আবার দেখছেন রাজনৈতিক অভিসন্ধি হিসেবে। কিন্তু ডাকসু এবার পুরনো ধাঁচের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বেছে নিয়েছে তরুণদের ভাষা-সৃজনশীল প্রতিউত্তর। সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক রিল, মিম, ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট- সব কিছু মিলিয়ে ডাকসু নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে রসিকতা ও যুক্তির সংমিশ্রণে। এতে শুধু বিতর্কের জবাব দেয়া হয়নি; বরং শিক্ষার্থীদের সাথে এক নতুন যোগাযোগের সেতু গড়ে উঠেছে।

এ সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রভাব এখন পুরো ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান। ডাকসুর পোস্টগুলো ভাইরাল হচ্ছে, ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ইতিবাচক স্লোগান- ‘বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের, পরিষ্কার রাখব আমরা।’ শিক্ষার্থীরা নিজেরা পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। এটি এক দিকে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াচ্ছে, অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বন্ধনও শক্ত করছে। দীর্ঘদিন পর ঢাবি এমন প্রাণচাঞ্চল্য দেখছে, যেখানে রাজনীতি নয়, উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তন আলোচনার কেন্দ্র।

এ পুরো অভিযাত্রার সামনের কাতারে দেখা যাচ্ছে ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য সর্বময় মিত্র চাকমাকে। তীব্র সমালোচনার মধ্যেও তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাহসের সাথে দৃঢ়ভাবে। তিনি জানেন, আজকের প্রজন্ম কেবল বক্তৃতায় বিশ্বাস করে না- তারা চায় ফল, দৃশ্যমান পরিবর্তন। সেই বাস্তবতা বুঝে তিনি ডাকসুকে এক নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছেন, যেখানে কাজই প্রধান ভাষা। তার কথায়, ‘ঢাবি যদি নিরাপদ না হয়, বাংলাদেশও নিরাপদ নয়।’ এ বাক্য এখন অনেকের মুখে মুখে ফিরছে, যেন এক বৃহত্তর জাতীয় বার্তা।

ডাকসুর এ কার্যক্রম কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পরিবর্তন আনছে না; বরং দেশের ছাত্র-রাজনীতির জন্যও একটি বার্তা দিচ্ছে। রাজনীতি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্যও হতে হবে- এ ধারণাই যেন নতুনভাবে ফিরিয়ে এনেছেন তারা। আর রিল, মিম, ভিডিও- এই নতুন প্রজন্মের ভাষায় বার্তা দেয়ার দক্ষতাও দেখিয়েছে, রাজনৈতিক যোগাযোগ কেমনভাবে আধুনিক হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বলছে- এখানকার প্রতিটি আন্দোলন একসময় জাতির ইতিহাসে প্রভাব ফেলেছে। তাই চাঁদাবাজমুক্ত, নিরাপদ ও মাদকমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার উদ্যোগও হয়তো আগামী দিনে বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করবে। সমালোচনা থাকবে, ভুল বোঝাবুঝি হবে- তবু এ আন্দোলন প্রমাণ করেছে, তরুণ প্রজন্ম এখন নিজেদের ক্যাম্পাস, নিজেদের পরিবেশ ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন, আত্মবিশ্বাসী এবং একতাবদ্ধ।

অভিযোগ রয়েছে, ডাকসুর এ ইতিবাচক অভিযানে মূলধারার অনেক মিডিয়া প্রত্যাশিত কভারেজ দিচ্ছে না; বরং যে কভারেজ মিলছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতিবাচক ও বিকৃত উপস্থাপনায় ভরা। ঢাবির শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন- চাঁদাবাজি, মাদক আর দখলবাজির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেটি কেন সংবাদে জায়গা পাচ্ছে না? জানা যায়, কিছু প্রভাবশালী বাম ঘরানার সংবাদমাধ্যম ইচ্ছাকৃতভাবে ডাকসুর এ উদ্যোগ বিতর্কিত করার নীতিতে চলছে। তাদের মতে, ডাকসুর এই সক্রিয়তা ‘রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে’, তাই এটিকে ‘ব্যক্তিনির্ভর প্রচারণা’ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।

আরো উদ্বেগজনক হলো- কিছু টেলিভিশন চ্যানেলকে নাকি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মহল থেকে সরাসরি ‘পরামর্শ’ দেয়া হয়েছে, ডাকসুর এ উদ্যোগকে যেন অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া না হয়। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও পেশাগত নৈতিকতার জন্য এটি একটি অস্বস্তিকর নজির। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, মাদকমুক্ত পরিবেশ ও ক্যাম্পাস সংস্কার কোনো দলীয় ইস্যু নয়, এটি জাতীয় স্বার্থের বিষয়। কিন্তু দেশের কিছু অংশ এখনো পুরনো মতাদর্শের খাঁচায় আটকে আছে, যেখানে ভালো উদ্যোগও প্রতিপক্ষের সাফল্য বলে গণ্য হয়।

এই মনোভাব কেবল সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের নয়; বরং একটি মানসিক কাঠামোর প্রতিফলন। ডাকসুর আন্দোলন সেই কাঠামো ভেঙে দিচ্ছে। তরুণদের হাতে ফেরাচ্ছে ইতিবাচক রাজনীতি, কাজের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিশ্বাস। মিডিয়া যদি এ নবজাগরণের সঙ্গী হতে না পারে, তবে ইতিহাস আবারো তাদের প্রান্তে ফেলে রাখবে। কারণ সময়ের স্রোত থেমে থাকে না- পরিবর্তনের ঢেউ শেষ পর্যন্ত সব প্রতিরোধ পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়।


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com