রবিবার ৮ জুন ২০২৫ ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
রবিবার ৮ জুন ২০২৫
 
মতামত
যুদ্ধ-জিগিরের বলিউডিকরণ





শান্তনু চক্রবর্তী
Sunday, 8 June, 2025
4:47 PM
 @palabadalnet

নরেন্দ্র মোদি যখন আরএসএস’র তরুণ প্রচারক, কিংবা তার আগে-পরে যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ‘অপার্থিব-অলৌকিক’ এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স’র পাঠ নিচ্ছিলেন, তখন কী প্রচুর বলিউডের সিনেমা দেখতেন? নইলে তার রাজনৈতিক কর্মসূচি আর জনসভায় বলিউডি চিত্রনাট্য আর সংলাপের এত রমরমা প্রভাব কেন? 

এই যেমন ক’দিন আগেই রাজস্থানে একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় প্রকল্পের উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি যা সংলাপ ঝেড়ে এলেন, তা ১৯৭০-৮০’র দশকে বলিউডের অনেক জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার সংলাপ লেখকদের লজ্জা দেবে। আমরা সবাই জানি পহেলগামে ঘটে যাওয়া  নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলা ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যাখ্যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে খুবই নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত অভিযান চা‍‌লিয়ে ৯টি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি বিধ্বস্ত করে দেয়। এই পুরোদস্তুর পেশাদার, কুশলী সেনা-অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিন্দুর’ কে দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফে কোনও মন্তব্য শোনা না গেলেও, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজির পোষ্য-বন্য-লালিত-চালিত মিডিয়া-বাহিনী টুক করে এক্সক্লুসিভটি ঠিক ভাসিয়ে দিয়েছেন, এই অপারেশনের নামকরণ থেকে লোগো ডিজাইন সবটাই নাকি মোদিরই মস্তিষ্কপ্রসূত, আমাদেরও সেরকমটাই মনে হয়েছিল। সেটা শুধু নামের ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের ‘ওভারটোন’ বলে নয়, ইংরেজিতে ‘সিন্দুর’ শব্দের একটা ‘ও’-কে টকটকে লাল সিঁদুর কৌটো বানিয়ে তোলার জন্যেও নয়- একটা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকাণ্ডের নির্ভেজাল বলিউডিকরণের জন্য। 

প্রতিশোধ বা বদলা বলিউডের একটা পুরানো কিন্তু পরীক্ষিত চিরকালীন সুপারহিট ফরমুলা। সেখানে নায়কেরা তাদের মা-বোনদের সিঁথির সিঁদুরের সঙ্গে যে সাংঘাতিক অন্যায়টা ঘটে গেছে, ছবির মাঝামাঝি বা ক্লাইম্যাক্সে এসে তার ভয়‌ঙ্কর প্রতিশোধ নেন। এখানেও বৈসরণ উপত্যকায় যে স্বঘোষিত ইসলামি সন্ত্রাসবাদী জেহাদিরা বেছে বেছে হিন্দু পুরুষদের হত্যা করেছিল এবং (সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত ভাষ্য অনুযায়ী) মেয়েদের গুলি না করে বলেছিল, ‘ফিরে গিয়ে মোদিকে বলো! তারাও যেন একটা ‘ডেনডেটা’ বা বদলা-কাহিনির প্রথম দৃশ্যটা সাজিয়ে দিয়েছিল। সেখানে কে নায়ক হবেন, কে ভারতীয় নারীদের সিঁথির সোহাগ মুছে দেওয়া ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিশোধ নেবে, সবটাই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

আর নরেন্দ্র মোদিও বলিউড তারকাদের মতই তার প্রথম ‘এন্ট্রি’ বা প্রবেশ থেকেই এই তৈরি চিত্রনাট্যের পুরো ফায়দা তোলার চেষ্টা করে গেছেন। তাই পহেলগামে নৃশংস হত্যালীলার দু’দিনের মাথায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ সর্বদলীয় বৈঠককে কাঁচকলা দেখিয়ে ভোটমুখী বিহারের জনসভায় ডায়ালগবাজি করলে চলে গেছেন। সেখান থেকেই সন্ত্রাসবাদীদের মদতদাতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের ন্যারেটিভ ভাসিয়ে দিয়েছেন। 

সেই সংলাপের ‘ডেলিভারি’র ভঙ্গি, কখনও মগ্ন-মন্ত্র, প্রায় অশ্রু-ভারাক্রান্ত রুদ্ধ স্বর, কখনও আক্রান্ত দেশবাসীর হয়ে নেওয়া কড়া শপথের উচ্চগ্রাম, অভিব্যক্তিতেও খেলা করা ২৫ ভাগ শোকের সঙ্গে ৭৫ ভাগ ক্রোধের হিসেবি আলো-ছায়া সবেরই নিখুঁত মিশেলে টেলিভিশনের পর্দায় প্রধানমন্ত্রীজি যেন তখন আর শুধুই কোনও ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি নন। তিনি তখন এই বিপন্ন আক্রান্ত ভূখণ্ডে, বিধর্মী দুশমনদের আক্রমণে নিহত সমস্ত হিন্দু-পুরুষের বিধবা স্ত্রীদের শূন্য সিঁথির ইজারাদার, ত্রাতা, শত্রু-সংহারক। বৈকুণ্ঠের বিষ্ণু-অবতার থেকে বলিউডের ধর্মেন্দ্র বা তস্যপুত্র সানি দেওল- দুর্বার, দাবাং, মাচো জাতীয়তাবাদে সবাই তার রোল-মডেল। আর ঘটনাচক্রে ধর্মেন্দ্র ও সানি দেওল দু’জনেই কোনও না কোনও সময় বিজেপি’র টিকিটে জিতেই লোকসভার সাংসদও হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনী জয়ের পেছনে আরএসএস-বি‍‌জেপি’র সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি পিতা-পুত্রের পর্দা-ইমেজও একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। বিশেষ করে সানি দেওল তো সেই ১৯৯০-এর দশকের ‘বর্ডার’ ছবি থেকেই বহিরঙ্গে পাকিস্তান, অন্তরমহলে ইসলাম ও মুসলিম-বিরোধী উগ্র-সন্ত্রাসবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঘোষিত ‘পোস্টার বয়’-যিনি খোদ পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে রামায়ণের হনুমানজী বা মহাভারতের ভীমসেনের মতই অসীম শক্তি ও পৌরুষের কথা বলে একটা আস্ত হ্যান্ড পাম্প উপড়ে নিয়ে গোটা পাক-বাহিনীকে দৌড় করাতে পারেন! 

পহেলগামের হত্যালীলার পরে মোদিজির ভক্ত-বাহিনী তাকে হয়ত এমনই সর্বশক্তিমান বলিউডি-বীরের ভূমিকায় দেখতে চেয়ে‌ছিলেন, সানি দেওলের মতো যিনি একা হাতে এই উপমহাদেশে সন্ত্রাসবাদের ধাত্রীভূমি পাকিস্তানের উপযুক্ত সবক শিখিয়ে আসবেন। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিরীহ-নিরস্ত্র-বেসামরিক পর্যটকদের (এখন অবশ্য পর্যটকরা কেন ‘অগ্নিবীর’-এর প্রকল্পের ট্রেনিং নিয়ে কাশ্মিরে যাননি, তাই নিয়েও বিজেপি নেতা-সাংসদেরা প্রশ্ন তুলছেন?) হত্যাকাণ্ড আর পাকিস্তানের অন্দরে সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলোয় আঘাত হানার জন্য ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাঝখানের দু’সপ্তাহের ‘প্রশিক্ষিত’ সমাজমাধ্যম-সেনা, ‘শত্রু’ নিপাতনে-সিদ্ধ ট্রোল-ব্রিগেড এবং বশংবদ গোদি-মিডিয়া খুব পরিকল্পিতভাবেই ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গোছের একটা গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে ফেলে। 

পাশাপাশি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনাতেও রাজ্যে রাজ্যে, শহরে শহরে, বাঙ্কার-এ ঢোকা-বেরোনোর মক্‌-ড্রিল, ব্ল্যাক আউট বা বাড়ি-ঘর, লোকালয়, জনজীবন নিষ্প্রদীপ রাখার অনুশীলন শুরু হয়ে যায়। 

আমেরিকা-প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক, সমাজ ও রাজনীতি‍‌-বিশ্লেষক বিজয় প্রসাদের মেয়ে, এসব কর্মকাণ্ড যতটা না দেশের নাগরিককে নিরাপদে রাখার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি করে তার মনের মধ্যে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব জাগিয়ে তোলার জন্য। সাইরেনের শব্দ, বাঙ্কারে দৌড়, অন্ধকার ঘন হলেই ঘরদোরের আলো নিভিয়ে দেওয়ার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা, মানুষের ক্রমশ এই বিশ্বাসটা তৈরি হয় যে তারা একটা যুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতরে আছেন। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় ভয়ের সংস্কৃতি, আর সেই ভয়ই রূপান্তরিত হয় ‘শত্রু’-র প্রতি ঘৃণায়। এখানে সেই ঘৃণার অভিমুখ যেমন রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে পাকিস্তান,  তেমনই তার ‘সহযো‍গী’ হিসাবে গোটা বি‍‌শ্বের মুসলিম-সমাজ। এবং অনিবার্যভাবেই ভারতীয় মুসলিমরা তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, সেটা বলাইবাহুল্য।

ভারতের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আর ভারতবর্ষীয় যাবতীয় সেকুলারদের সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়ার নিন্দান-হাঁকা ‘কুসুমরঞ্জন’ একা নয়-জাতীয়তার বৃন্ত থেকে সম্প্রীতির কুসুমগুলোকে কুচি কুচি করে ছেঁড়ার জন্য আরও অনেক কুসুমকুমার-কুসুমকুমারীরা চ্যানেলে চ্যানেলে। ইনস্টাগ্রাম-ফেসবুক-এক্সহ্যান্ডলে মজুত থেকেছে। 

অপারেশন সিঁদুর-এর আগের দু’হপ্তায় উত্তর ভারতের শহরে শহরে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-এনআইটি-আইআইটি’র ক্যাম্পাসে স্রেফ কাশ্মিরি পরিচয়ের জন্য ছাত্র-ছাত্রী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ ভয়ঙ্কর হেনস্তার মুখোমুখি হয়েছেন। এই দু’সপ্তাহের মধ্যেই গোটা দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তিনশোরও বেশি- শুধু সংখ্যালঘু পরিচয়ের জন্য নিহত হয়েছেন আমাদের তিনজন সহ-নাগরিক। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে নামার আগে ত্রয়ের ‘ওয়ার্ম-আপ সেশন’-ভারতজোড়া ঘৃণার আগুনে সাম্প্রদায়িক হিন্দু-জাতীয়তাবাদের একটু গা-ঘামিয়ে নেওয়া।

এই সময়টার মধ্যে নরেন্দ্র মোদিকে ‘গদর’ বা ‘মা তুঝে সালাম’-এর সানি দেওল ধরে নিয়ে, সঙ্ঘের সনাতনি পারিবারিক বাস্তুতন্ত্র, সামাজিক মাধ্যম ও পোষ্য-বশ্য সংবাদ-চ্যানেলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণের যে বলিউডি ইচ্ছাপূরণের চিত্রনাট্য ফেঁদে ফেলেছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্দিষ্ট, নির্ধারিত, সীমিত সামরিক কর্মসূচিতে তাদের মন ওঠার কথা নয়। সেজন্যেই ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর দু’দিনের মধ্যেই চ্যানেলে চ্যানেলে লাহোর-ইসলামাবাদ দখল, করাচির ধ্বংসস্তূপ। স্বাধীন বেলুচিস্তানের ‘জুম্‌লা বা গালগল্প প্রচার করতে হয়েছিল। 

সেসব ‘ফেক নিউজ’-এর জারিজুরি বা মিথ্যা-কল্প ধরা প‍‌ড়ে যাওয়ার আগেই একটা জিনিস দিনের আলোর মতোই প্রমাণ হয়ে ‍‌গিয়েছিল। সেটা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের যুদ্ধ-উন্মাদনা ও গণজিঘাংসা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, যেখানে একজন সংবেদনশীল, আপাতভাবে উদার প্রগতিবাদী রাজনৈতিক বিশ্লেষকও সংবাদ-চ্যানেলের স্টুডিও-য় বসে, সঞ্চালকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, ইসলামাবাদের মাটিতে ভারতীয় সেনা-কুচকাওয়াজের জাতীয়তাবাদী-জুমলায় উচ্ছ্বাসের হাততালিতে ফেটে পড়েন।

আসলে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটা এখানে খুব পরিষ্কার। ভারতীয় সেনাবাহিনী, যা পুরোদস্তুর একটি পেশাদার ও সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, তারা গোটা অপারেশনটাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক সীমিত সামরিক অ্যাকশন হিসাবেই দেখতে চেয়েছিলেন। কারণ তারা জানেন যুদ্ধ আসলে কী আর প্রতিক্রিয়া কতটা এবং কতদূর! 

কিন্তু যুদ্ধ যাদের কাছে ভিডিও গেমস, বড়জোর ইরাক-গাজা-ইউক্রেনের নিউজ-ক্লিপিংস বা রিলস্‌, তারাই মোদিকে বিমানবাহিনীর উইং কম্যান্ডোদের রণসাজে সাজিয়ে দেশজুড়ে হোর্ডিং লাগান। এরাই বিশ্বাস করেছিলেন ‘মোদি হ্যায় তো, মুমকিন্‌ হ্যায়’ - তাই আগামী গ্রীষ্মে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের সৌন্দর্য উপভোগ করে আসা যাবে। কিন্তু সেই মোদিই যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ধমকে আচমকা যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন এই যুদ্ধবাজ ট্রোল-বাহিনীর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল পররাষ্ট্র সচিবের ওপর। যেন যুদ্ধ বিরতির সরকারি ঘোষণাটা তিনিই করছেন বলে, সিদ্ধান্তও তারই নেওয়া। আসলে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির হিন্দু-হৃদয়সম্রাট যে নতজানু হতে পারেন, এটা তাদের কাছে ‘মুমকিন্‌’ নয়। তার চেয়ে অনেক সহজ পররাষ্ট্র সচিবের মেয়েকে ‘টার্গেট’ করা। কারণ তিনি জাতিসংঘের হয়ে গাজার ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের নিয়ে কোনও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্যালেস্তাইন-হামাস-সন্ত্রাসবাদী-মুসলিম-পহেলগাম-হিন্দুবিরোধী-পাকিস্তানপন্থী-সমীকরণটা খুব সরল হয়ে যায়।

নাৎসি-বাহিনীর হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে যাওয়া পোল্যান্ডের সমাজ মনস্তাত্ত্বিক হেনরি তাজফেল অনেক বছর আগে তার ‘সামাজিক পরিচ‌য়’-এর তত্ত্বে দেখিয়েছিলেন কী করে একটা সমাজ বা জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ একইরকম কু-যুক্তি, কু-সংস্কার একইরকম অন্ধত্ব আর স্টিরিওটাইপিং-এর চাষ করে। কী নিশ্চিন্তে আমরা-ওরার দু’টো ‘খোপ’ বানিয়ে ফেলে। আর নিজেদের ভাবনা বৃন্তের বাইরের সব্বাইকে সেই ‘ওরা’ বা অপর-এর খোপে ফেলে দেয়। পহেলগাম উত্তর ভারতে আমরা বারবার তাজফেলের তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখেছি। 

বৈসরণে নিহত বায়ুসেনা অফিসার বিনদ নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশি যখন বলেন, কাশ্মিরে হিন্দু পর্যটকদের হত্যার দায় স্থানীয় সাধারণ কাশ্মিরি ও গোটা ভারতীয় মুসলিম সমাজের ওপর চাপানোটা অন্যায়, তক্ষুনি তাকে কুৎসিত ব্যক্তিগত আক্রমণ করা শুরু হয়ে যায়। কারণ কুসুমরঞ্জনরা যে উগ্র হিন্দুত্বের ন্যারেটিভটা তৈরি করছিলেন, হিমাংশির বিবৃতি সেই খোপে পড়ে না। এখানেও সেই সনাতনী হিন্দু নারীর সতীত্ব, পরিব্রাত্যের স্টিরিওটাইপিং বা মোদিজীর সিঁদুর খেলা। যে সন্ত্রাসবাদী ইসলাম তোমার স্বামীর প্রাণ নিয়েছে তুমি যদি সামগ্রিক বা গড়পড়তাভাবে সেই ধর্ম বা ধর্মাবলম্বী মানুষদের বিরোধিতা করতে না পারো-সেখানে পৃথকীকরণ করো, সহানুভূতি বা কৃতজ্ঞতার জায়গা ছে‍ড়ে রাখো-তাহলে তোমার ‘সামাজিক পরিচয়’ নিয়ে আমাদের সন্দেহ জাগবে। আমরা তখন হিমাংশির মুসলিম পূর্ব-প্রেমিক বা ‘লাভ-জিহাদের’ গন্ধ অবধি খুঁজে পেয়ে যাব।

ওই খোপে আঁটা স্টিরিওটাইপিং, কু-সংস্কার বা সামাজিক পরিচয় তত্ত্বের রকমফেরেই মধ্য প্রদেশের বিজেপি মন্ত্রীমশাই সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সোফিয়া কুরেশিকে পহেলগামের সন্ত্রাসীদের বোন বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। আর তার পরেও তার মন্ত্রীপদ অটুট থেকে যায়। এমন কি দলের তরফে তাকে কোনও ভর্ৎসনা করা হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যায় না। অথচ তারপরেও যদি সোফিয়া ও বিমানবাহিনীর মহিলা অফিসার ব্যোমিকা সিন্ধে দিয়ে ‘অপারেশন সিঁন্দুর’ সংক্রান্ত সাংবাদিক সম্মেলন করানোর সরকারি সিদ্ধান্তকে যদি কারুর ‘অপটিক্স’ বা দৃশ্যমায়া নির্মাণের চেষ্টা বলে মনে হয়, সেটা প্রকাশ্যে বলাটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। বিশেষ সংশয়ী সেই ব্যক্তির নাম যদি আলি খান মেহমুদাবাদের মতো কিছু হয়, তাহলে তিনি অবশ্যই সন্দেহভাজনদের তালিকায় ঢুকে পড়তে পারেন। তখন অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেও তাকে প্রায় সন্ত্রাসবাদীদের মতই গ্রেপ্তার করে ফাটকে পোরা যায়। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন পেলেও তাকে বিচারপতির বকুনি শুনতে হয়, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার দরকারটাই বা কী?

আসলে বর্তমান পরিস্থিতিতে বোধহয় মোদির ওইসব বলিউডি সংলাপগুলোই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বা মানানসই। বিশেষ করে ট্রাম্পের চাপে দু’দেশের যুদ্ধ-বিরতির বিষয়টা অস্বীকার করার জায়গাটা যতই ছোট হয়ে আসছে, নিজেকে বীর প্রমাণ করার দায়টা মোদির ততই ঘাড়ে চেপে বসছে। আর ১৯৮০-’৯০-এর দশকের বলিউডি মশালা ছবি ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ডিএনএ বা ফরমুলা মোটামুটি একই। সেটা মূলত উত্তর ভারতীয়, উচ্চবর্ণীয়, পেশিনির্ভর পুরুষতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নারী সেখানে প্রান্তিক দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। সম্মাননার নাম করে মেয়েদের অপমান করাই সেখানে দস্তুর। ভাই ‘ফুল বনে অঙ্গার’, ‘খুন ভরি মাঙ্গ’ বা ‘বোমারু রক্তে আমার সোহাগ’ গোছের সিনেমা-টাইটেল-এর খুব গা ঘেঁষেই মোদিজি ‘সিঁদুর বলা গয়ে বারুদ’-এর মতো সংলাপ বলবেন। বা ‘আমার শিরায় শিরায় গরম সিঁদুর বইছে’ জাতীয় নন-বা‍‌য়োলজিক্যাল ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়ে হাততালি কুড়োবেন। কিন্তু পুঞ্চ বা রাজৌরিতে পাকিস্তানি গোলা-বোমা-বুলেটে নিহত জনা তিরিশের গরিব, প্রান্তিক, খেটে-খাওয়া মানুষের ধর্ম-শ্রেণি-সামাজিক পরিচয় কী ছিল, তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবো না। কারণ আমাদের বলিউডি যুদ্ধ খেলায় ওইটুকু তো ‘কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ’ মাত্র।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বোধহয় প্রধানমন্ত্রীজীর ওইসব বলিউডি সংলাপগুলোই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বা মানানসই। বিশেষ করে ট্রাম্পের চাপে দু’দেশের যুদ্ধ-বিরতির বিষয়টা অস্বীকার করার জায়গাটা যতই ছোট হয়ে আসছে, নিজেকে বীর প্রমাণ করার দায়টা মোদিজির ততই ঘাড়ে চেপে বসছে।

সূত্র: দৈনিক গণশক্তি


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com