রবিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩ আশ্বিন ১৪৩২
রবিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
 
বিদেশ
জাতিসংঘে নেতানিয়াহু ভাষণ দিতে এলেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বেরিয়ে যান অনেক প্রতিনিধি





আল–জাজিরা
Saturday, 27 September, 2025
1:26 AM
 @palabadalnet

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বক্তব্য দিতে এলে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান অনেক দেশের প্রতিনিধি। ২৬ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে। ছবি: এএফপি

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বক্তব্য দিতে এলে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান অনেক দেশের প্রতিনিধি। ২৬ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে। ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনে চলমান আগ্রাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ সময় অনেক দেশের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানিয়ে অধিবেশন কক্ষ বর্জন করেন। নেতানিয়াহুর ভাষণ ঘিরে বড় বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের চতুর্থ দিন ছিল শুক্রবার। এদিন ভাষণের জন্য নেতানিয়াহুর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। একপর্যায়ে তারা অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ (ওয়াকআউট) করেন। প্রতিনিধিরা যখন অধিবেশন কক্ষ ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত অনেকে হাততালি দেন। এ সময় শিস বাজাতেও শোনা যায়।

পরিষদের সভাপতি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বললেও তাতে কাজ হয়নি। পরে নেতানিয়াহু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন তার সামনের আসনগুলো ফাঁকা দেখা যায়। প্রায় সব আরব ও মুসলিম দেশ, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা অধিবেশন বর্জন করেছিলেন।

জাতিসংঘের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্য, গাজা সংঘাত, ইরানসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ঠিক একই সময়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের কাছে গাজায় জাতিগত নিধনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার মানুষ। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে এদিন নিউইয়র্কে বিক্ষোভ করেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইসরায়েলি ও ইহুদিরাও।

এবারের জাতিসংঘের অধিবেশনে গাজা সংকট বড় গুরুত্ব পেয়েছে। মঙ্গলবার অধিবেশন শুরুর আগে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে পশ্চিমা ১০ দেশ। অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের নেতারা। যেমন জাতিগত নিধনের অভিযোগে নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) তোলার দাবি জানান চিলির প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বরিচ।

ইতিমধ্যে আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের অভিযোগে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আইসিসি। সে কারণে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে ফ্রান্সের আকাশসীমা এড়িয়ে গিয়েছিল তার উড়োজাহাজ। তবে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ইসরালের সবচেয়ে বড় মিত্র আর আইসিসির সদস্য নয়, তাই সেখানে তার গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা নেই।

টাইমস স্কয়ারে মানুষের ঢল

জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণের দিন শুক্রবার ভোর থেকেই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ভবনের কাছে টাইমস স্কয়ারে জড়ো হতে থাকেন বহু মানুষ। বেশির ভাগই তরুণ। অনেকের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার। তাতে লেখা ছিল ‘ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ করুন’, ‘নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করুন’, ‘গাজাকে অনাহারে রাখা এখনই বন্ধ করুন’-এমন সব স্লোগান।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবরে বলা হয়, টাইমস স্কয়ারে বিক্ষোভ সমাবেশের এক পর্যায়ে ঘোষণা দেওয়া হয়, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেছেন। তখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বিক্ষোভকারীরা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষে তারা জাতিসংঘ ভবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজারে পৌঁছায়।

এই বিক্ষোভকারীদের একজন ব্রুকলিন এলাকার বাসিন্দা ডেভিড রবিনসন (৬৪)। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের মানুষ বলে মনে করা হয় না। এটি (হত্যাযজ্ঞ) ঘটেই যাচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব আমার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে।”  

গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছান নেতানিয়াহু। সেখানে ম্যানহাটান এলাকায় যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছেন, তার বাইরেও বিক্ষোভ করেছেন ইহুদি ও ইসরায়েলি প্রবাসীরা। এ সময় তাদের ‘যুদ্ধ বন্ধ করুন’, ‘তাদের (জিম্মি) সবাইকে মুক্ত করুন’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। ড্রামের শব্দের তালে তালে অনেকেই বলছিলেন, “সামরিকভাবে এর (সংঘাত) সমাধান হবে না।”

নেতানিয়াহুর সাফাই

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর ভাষণের বড় অংশ ছিল গাজায় চলমান সংঘাত নিয়ে। দুই বছর ধরে গাজায় চলমান ইসরায়েলি নৃশংসতার পক্ষে সাফাই তুলে ধরেন তিনি। এই সময়ে উপত্যকাটিতে ইসরায়েলি বাহিনী সাড়ে ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলেও, নেতানিয়াহু দাবি করেন, জাতিগত নিধনের সঙ্গে জড়িত নয় তার দেশ।

গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের গঠন করা একটি স্বাধীন কমিশনের তদন্তে। একে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘে নেতানিয়াহু বলেন, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসই উল্টো বেসামরিক মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুক্তি দেখিয়ে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ন্যায্যতা পেতে পারে না।

ভাষণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন নেতানিয়াহু। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার তুলনা করেন তিনি। নেতানিয়াহু বলেন, “৭ অক্টোবরের পর জেরুজালেমের এক মাইল দূরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রাষ্ট্র দেওয়া ১১ সেপ্টেম্বরের পর নিউইয়র্কের এক মাইল দূরে আল=কায়েদাকে একটি রাষ্ট্র দেওয়ার মতো।”

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ যে ১০ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারও সমালোচনা করেন নেতানিয়াহু। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ১৫৭টিই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি ইহুদিদের ওপর হামলা বাড়িয়ে তুলবে দাবি করে নেতানিয়াহু বলেন, “আপনারা সঠিক কাজটি করেননি। আপনারা যা করেছেন, তা ভুল কাজ। মারাত্মক ভুল কাজ।”

অধিবেশনে গাজায় ইসরায়েলের ‘যুদ্ধ’ এখনো শেষ হয়ে যায়নি বলে উল্লেখ করেন নেতানিয়াহু। উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের আগ্রাসনের জন্য সাধারণ পরিষদে যেসব দেশ নিন্দা জানিয়েছে, তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আপনারা জানেন যে ইসরায়েল আপনাদের হয়েই লড়াই করছে। তাই পর্দার আড়ালের একটি গোপন কথা আপনাদের বলতে চাই। তা হলো, অনেক নেতাই প্রকাশ্যে আমাদের নিন্দা করেন আর আড়ালে ধন্যবাদ জানান।”

‘নেতানিয়াহুর ভাষণে জনমত বদলাবে না’

জাতিসংঘের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর পর বক্তব্য দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলদারি ও গাজায় জাতিগত নিধনের নিন্দা জানান তিনি। ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি শিশু হিন্দ রজবের দিকে ইঙ্গিত করে শাহবাজ বলেন, “ছোট্ট শিশু হিন্দ রজবের কথাটা ভাবতে পারেন? সে যেন আমাদেরই মেয়ে।”

ভাষণে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দেওয়া যাবে না। আর গাজায় হত্যাযজ্ঞের সমালোচনা করে সেন্ট ভিনসেন্টের প্রধানমন্ত্রী রালফ গনসালভেস বলেন, “জাতিগত নিধনে জড়িত এবং তাদের সহায়তাকারীদের জন্য নরকের সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান নির্ধারিত রয়েছে।”

জাতিসংঘে নেতানিয়াহু যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে গাজায় জাতিগত নিধন নিয়ে বিশ্বের মানুষের জনমত বদলাবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) যোগাযোগবিষয়ক সাবেক পরিচালক জেভিয়ার আবু ইদ। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, নেতানিয়াহু এমন ভাষণ দেবেন, তা জানাই ছিল। তিনি একঘরে হয়ে পড়েছেন। এই ভাষণের জেরে গাজায় ইসরায়েল যে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে, তা নিয়ে বৈশ্বিক জনমত বদলাবে না।

‘বিশ্ব দেখছে আমরা মারা যাচ্ছি’

জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যখন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে, তখন গতকাল গাজায় নির্বিচার হামলা চালাচ্ছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। তাদের মধ্যে ১১ জন ত্রাণের খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুটি শিশুও রয়েছে।

এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চলমান ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৫ হাজার ৫০২ জন ফিলিস্তিনি। আহত ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। গাজায় হামলা শুরুর আগে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় আড়াই শ জনকে।

গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে যে ১১ জন নিহত হয়েছেন, তারা মধ্য গাজার নেতজারিম করিডরের কাছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বিতর্কিত একটি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। তখন তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। গতকাল গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপত্যকাটিতে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

শুক্রবার গাজায় নিহতদের মধ্যে ২৮ জনই গাজা নগরীর। উপত্যকাটির উত্তর ভাগে এই শহর এলাকায় ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। নগরীর রেমাল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আল-সালোউল আল-জাজিরাকে বলেন, “ইসরায়েলের এই হামলা যেকোনো যৌক্তিকতা ও মানবিকতার বাইরে। বিশ্ব কী করছে? আমরা মারা যাচ্ছি, তা শুধু তারা দেখছে।”

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com