ঢাকা: প্রথম দফায় দুইদিন জ্বরে ভোগার কয়েকদিন পর দ্বিতীয় দফায় আবারো তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হন ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন। এরপর রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ভর্তি হন হাসপাতালে। এভাবেই নিজের অসুস্থতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন রাজধানীর শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত ২৮ বছর বয়সি কবির হোসেন।
তিনি জানান, শুরুতে সাধারণ জ্বর ভেবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেয়ে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা এবং বারবার বাথরুমে যেতে হচ্ছিলো। পরে বাধ্য হয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি।
সরেজমিনে হাসপাতালটি ঘুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা হয় বিবিসি বাংলার। যাদের অধিকাংশেরই বয়স ৩০-এর কাছাকাছি। আর প্রত্যেকেই চাকরি, ব্যবসাসহ বাইরের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত।
কথা হচ্ছিল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি নওগাঁর বাসিন্দা সুলতান আহমেদের সঙ্গে। তিনিও বেশ কিছুদিন যাবত জ্বরে ভুগে ও শরীরে তীব্র ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের আনাগানো রয়েছে, তবে হঠাৎই গত তিনদিনে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ রোগীর বয়সই ৩০ বছরের কম।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের ক্ষেত্রে সাধারণত এই বয়সীদের সংখ্যা যেমন বেশি থাকে, তেমনি তাদের সেরে ওঠার হারও বেশি। তবে এক্ষেত্রে এই বছরের চিত্র এখন পর্যন্ত কিছুটা ভিন্ন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩০-এর কম বয়সী রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যই বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানো ১৮৭ জনের মধ্যে ৯৪ জনেরই বয়স ৩০ বছরের নিচে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর খুব কম সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মৃত্যু হওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। এর কারণ হিসেবে সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়ায় 'শক সিনড্রোম' তৈরি হওয়ার কথা জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩ হাজার ৮৪১ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যা ১৮৭।
আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের বাসিন্দাদের।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এবছর মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত নয়। তবে, ত্রিশের কম বয়সীদের মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা হলেও চিন্তার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, জীবন-জীবিকায় জড়িত থাকার কারণে বিশেষ করে ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা সবসময়ই ডেঙ্গু আক্রান্তের বাড়তি ঝুঁকিতে থাকেন। এছাড়া শ্রমজীবী মানুষ যারা ঘরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে কাজে নিয়োজিত থাকেন তারাও বেশি আক্রান্ত হন।
“বিশেষ করে যারা আনপ্রটেকটেড অবস্থায় বাজার-ঘাট, রাস্তা, পরিবহনে থাকেন বা নির্মাণ শ্রমিক এরাই বেশি আক্রান্ত হন। তবে, তাদের মৃত্যুর সংখ্যা বয়স্ক ও শিশুদের তুলনায় যদি বেশি হয় তাহলে এটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তরুণ বয়সের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তো বেশি," বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।
এই বয়সসীমার ব্যক্তিদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে 'শক সিনড্রোম' এর কথা বলছেন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষা কিংবা হাসপাতালে আসতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। অনেকে অবহেলা করে শেষ পর্যন্ত নিরূপায় হয়েই হাসপাতালে যান, যা রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়।
এই চিকিৎসক বলছেন, “সাধরণত বাচ্চা কিংবা বয়স্কদের ক্ষেত্রে একটু জ্বর হলেই আমরা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু বিশেষ করে যাদের বয়স ১৬ থেকে ৩৫ এর মধ্যে তাদের নিজেদের ব্যাপারে একটু সচেতনতা কম।”
“এই গ্রুপের ব্যক্তিরা মনে করে আমি তো যথেষ্ট শক্তিশালী, আমি তো সাসটেইন করতে পারবো। কিন্তু যখন তারা শকে চলে যায় তখন কিন্তু আমাদের (চিকিৎসকদের) হাতে সময় অনেক কমে যায়। ওই রোগী রিসাসিটেশন করার (শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখা) সম্ভাবনাটা অনেক কমে যায়, ফলে তাদের মৃত্যু ঘটে,” বলেই মনে করে আহসান।
‘শক সিনড্রোমে’ বেশি মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মারা যাওয়ার হার বেশি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু চিহ্নিত হওয়ার শুরুতেই চিকিৎসা শুরু না হলে অনেক সময় দ্রুত জটিল আকার ধারণ করতে পারে যা রোগীর মৃত্যুর শঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৫৬ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। আর ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে জটিল উপসর্গে।
এছাড়া এবছর হেমোরেজিক সিনড্রোম বা ডিএসএস ও বিইডিএসের কারণে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে নয় জনের, অঙ্গ বিকলজনিত জটিলতা ও বহু অঙ্গ বিকলের কারণে পাঁচ জনের এবং হৃদযন্ত্রের শকে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগে মারা গেছেন ছয় জন।
শরীরে অন্য কোনো জটিলতা থাকলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায় বলেও জানান চিকিৎসকরা। অনেক সময় অন্য রোগ না থাকলেও কেবল অবহেলাজনিত দেরির কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে হেমোরেজিক সিনড্রোম দেখা যেতে পারে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বিবিসি বাংলার কথা হয় এমন একজন ডেঙ্গু রোগীর সঙ্গে। ঢাকার আলমনগর হাউজিংয়ের বাসিন্দা রাজিয়া বেগম হেমোরেজিক সিনড্রোম নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন এই হাসপাতালে।
“আমার চোখে রক্ত জমে গেছে, শরীরে প্রচুর ব্যাথা, হাতে ফোসকা পড়ে গেছে, শরীর জ্বালাপোড়া করে, ঘুম হয় না রাতে,” বলেন তিনি।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আকান্ত হওয়ার তিনদিন পর থেকেই মূলত একজন রোগীর শারীরিক অবস্থা বেশি অবনতির দিকে যেতে শুরু করে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান বলছেন, পেটে ব্যাথা থাকা, তিন বারের বেশি বমি করা, বারবার বাথরুমে যাওয়া, শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে কিনা এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
জ্বর হলে বা ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর এই বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখা দরকার।
তিনি বলছেন, রোগ চিহ্নিত হওয়ার শুরুতেই চিকিৎসা শুরু না হলে, অনেক সময় রোগ দ্রুত জটিল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে শক, রক্তক্ষরণ ও অঙ্গ বিকলের মতো জটিলতা দেখা দিলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
“ডেঙ্গু রোগীর ওয়ার্নিং সাইনের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। জ্বর হলে অবহেলা না করে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু পজিটিভ হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে,” বলেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, ডেঙ্গুতে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দেরিতে হাসপাতালে আসায় 'শক সিন্ড্রোম' থেকে বের হওয়ার আর সুযোগ থাকছে না। বিশেষ করে ঢাকা বাইরে থেকে যেসব রোগীকে ঢাকায় আনা হয়।
সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর প্রভাব অনেক বেশি বাড়তে থাকে। তাই এই সময়ে অনেক বেশি সচেতন থাকা জরুরি বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসবরা।