
জোহরান মামদানি। ছবি: এএফপি
নিউইয়র্কের কুইন্সে সেদিনের সকালটি শুরু হয়েছিল উজ্জ্বল আলো নিয়ে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল এক নতুন যুগের। নির্বাচনে জেতার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন জোহরান মামদানি ও তার প্রচারণা দল। ধারণা করা যায়, বিজয়ের রাতে তাকে ঘরে ফিরতে হয়েছিল দেরি করে। কিন্তু, বিজয়ের পরদিন ভোরেই শুরু হয়ে যায় তার ‘ঘর গোছানো’র কাজ।
গত ৫ নভেম্বর তথা মেয়র নির্বাচনের পরদিন সাত সকালে নিউইয়র্কে নিজের মহল্লা কুইন্সে সাংবাদিক সম্মেলন করেন নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা পাঁচ নারী-ইলানা লিওপোল্ড, মারিয়া টোরেস-স্প্রিংগার, গ্রেস বোনিলা, লিনা খান ও মেলানি হারৎজগকে পরিচয় করিয়ে দেন তার উপদেষ্টা হিসেবে।
নিউইয়র্কে একটি রৌদ্রোজ্জ্বল নতুন দিনের শুরুতে এই গুণী নারীদের নিয়ে অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে প্রথা ভাঙেন ৩৪ বছর বয়সী এই তারকা রাজনীতিক।
বিশ্ব রাজনীতিতে ‘পঞ্চশক্তি’ মূলত পাঁচ মহাশক্তিধর দেশকে বোঝায়। তবে এই লেখায় ’পঞ্চশক্তি’ বলতে সেই পাঁচ প্রতিভাবান নারীকে বোঝানো হচ্ছে, যাদের জোহরান মামদানি নিজের উপদেষ্টা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
শুধু সদা হাসিমাখা মুখে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে নয়, সেই নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোটারের মন জয় করে জোহরান মামদানি নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তার কাছে নিউইয়র্কবাসীর প্রত্যাশা এখন আকাশচুম্বী, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু, প্রশ্ন-প্রথা ভাঙা এই নেতা তার ‘পঞ্চশক্তি’তে বলীয়ান হয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন তো?
নির্বাচনী প্রচারণায় জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেগুলো পূরণে সহায়তার জন্যই এই অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা দল।
আগামী ১ জানুয়ারি মেয়র হিসেবে শপথ নেবেন জোহরান মামদানি। মাঝের এই সময়ে এই উপদেষ্টারা কাজ করবেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রক্রিয়া নিয়ে।
মজার বিষয় হচ্ছে-পাঁচ নারীকে নিয়ে জোহরান মামদানির এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন নিয়ে বিরোধীদের কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাদের নিয়ে কোনো নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। এমনকি, তাদের কারো যোগ্যতা নিয়েও কোনো টেলিভিশনে বিশ্লেষকদের আলোচনায় কাউকে প্রশ্ন তুলতে দেখা যাচ্ছে না। অথবা, কোনো সংবাদ প্রতিবেদনে তাদের কারো অযোগ্যতার চিত্রও উঠে আসেনি।
টাইম সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিউইয়র্কের গত তিন মেয়রের প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এই উপদেষ্টাদের। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, নিউইয়র্ক মহানগরী ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতাও আছে কারো কারো।
এই অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা পরিষদের নির্বাহী পরিচালক ইলানা লিওপোল্ড কাজ করেছিলেন নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র বিল ডি ব্লাসিওর সঙ্গে। বাকি সবাই অর্থাৎ, সাবেক ফার্স্ট ডেপুটি-মেয়র মারিয়া টোরেস-স্প্রিংগার, ফেডারেল ট্রেড কমিশনের সাবেক সভাপতি লিনা খান, ইউনাইটেড ওয়ে অব নিউইয়র্ক সিটির সভাপতি গ্রেস বোনিলা ও নগরীর বাজেট বিশেষজ্ঞ মেলানি হারৎজগ থাকছেন উপদেষ্টা দলের সহ-সভাপতি হিসেবে।
সাময়িকীটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়-উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নির্বাচনের পরদিন থেকে মেয়রের শপথ নেওয়া পর্যন্ত নগরীর অর্থনীতি, বাজেট, আবাসন ও সমাজসেবা সংক্রান্ত কাজগুলো নিয়ে গবেষণা করবেন। মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানি তার পুরসভার প্রায় তিন লাখ কর্মী ও ১০০ বিলিয়ন ডলার বাজেটের অভিভাবক।
সেই সংবাদ সম্মেলনে নতুন মেয়র জানান, তার মহানগরীর ‘পুরোনো সমস্যা দূর করা হবে নতুন সমাধান সূত্র দিয়ে’।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় অনেকে বলেছিলেন, জোহরান মামদানি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভোটারদের মন জয় করছেন। আর বিজয়ের পরদিন তিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুয়োমোর বাবা নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর মারিও কুয়োমার কথার প্রতিধ্বনি করে বলেন, “মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রচারণার কাজ গত রাত ৯টায় শেষ হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে সেবা করার অম্ল-মধুর দিন।”
নির্বাচনের সময় অনেকের আশঙ্কা ছিল জোহরান মামদানির বড় পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নেই বলে তিনি হয়ত ব্যর্থ হবেন। কিন্তু, বাস্তবে দেখা গেল নিউইয়র্ক মহানগরীর প্রায় ২০ লাখ ভোটার মেয়র নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। এই সংখ্যা গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। আবার ভোটারদের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট দিয়েছেন জোহরান মামদানিকে।
নির্বাচনী প্রচারণায় যেসব কঠিন কঠিন প্রতিশ্রুতি জোহরান মামদানি দিয়েছিলেন সেগুলো পূরণে শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদও গঠন করেছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, নির্বাচন উপলক্ষে জোহরান মামদানি শক্তিশালী প্রচারণা বাহিনী গঠন করেছিলেন এবং তা তাকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। তাদের আশা-এই উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন।
গত ৬ নভেম্বর সিএনএন জানায়, অন্তর্বর্তী প্রশাসন চালানোর খরচ মেটাতে জোহরান মামদানি তার সমর্থকদের অনুদান দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক মাস আগে আপনাদেরকে অর্থ না পাঠানোর অনুরোধ করেছিলাম। আজ আবার অনুরোধ করছি তা পাঠানোর জন্য।”
তিনি জানান-অন্তর্বর্তী উপদেষ্টাদের গবেষণা কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আরও কর্মী প্রয়োজন। এ ছাড়াও, প্রয়োজন অবকাঠামোগত সুবিধার। আর এসবের খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজন বাড়তি অর্থ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, জোহরান মামদানি তার প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য কোনো ধনী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করেননি। ধনকুবেরদের নগরী হিসেবে সুপরিচিত নিউইয়র্কের সাধারণ মানুষের দেওয়া অর্থে তিনি নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। এখন সেই সাধারণ মানুষের কাছে হাত পেতেছেন তাদের ভাগ্য বদলানোর কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দেখা যায়, সাধারণত ধনীরা রাজনীতিকদের অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকেন। এরপর তারা বিজয়ী নেতাদের কাছ থেকে নানা রকম সুবিধা নিয়ে সেই অর্থের উসুল তোলেন। বিপরীতে, জোহরান মামদানি অর্থ সহায়তা নিচ্ছেন তার সমর্থক সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে, তাদের সুবিধার জন্যই।
এদিকে, আজ ৯ নভেম্বর বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়-ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে জোহরান মামদানির গণবান্ধব প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করবেন। এতে আরও তুলে হয় যে-নির্বাচনের শুরু থেকেই জোহরান মামদানিকে পরাজিত করতে ট্রাম্প কীভাবে কাজ করেছিলেন। শেষে ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে তিনি নিউইয়র্কের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রীয় সরকারে অর্থ বন্ধ করে দেবেন। জোহরান মামদানির বিজয়ের পর সমাজমাধ্যমে ট্রাম্প বলেন, “এখন তা শুরু হলো।”
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ব্রিটিশ গণমাধ্যমটিকে বলেন যে, ট্রাম্প যদি চান তাহলে জোহরান মামদানিকে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে ফেলতে পারেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জুলিয়ান জেলিজারের ভাষ্য, “ট্রাম্প নিউইয়র্কের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারেন। তিনি নবনির্বাচিত মেয়রের জন্যও সমস্যা তৈরি করতে পারেন।”
এ বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে জোহরান মামদানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, এমন পরিস্থিতিতে বলা যায় যে-জোহরান মামদানি ও তার উপদেষ্টাদের সাফল্য নির্ভর করবে তাদের সততার ওপর।
পালাবদল/এমএম