
দীর্ঘদিন ধরে পানি সংকটে ভুগছেন ইরানিরা। ছবি: সংগৃহীত
ইরানের রাজধানী তেহরান চলতি মৌসুমে নজিরবিহীন খরার মুখোমুখি হয়েছে। বৃষ্টিপাত রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে। জলাধারগুলো প্রায় পানিশূন্য। পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় কর্মকর্তারা নাগরিকদের পানি সংরক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সতর্ক করে বলেছেন, যদি শিগগিরই পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হয়, তবে তেহরানে পানি রেশনিং করা হতে পারে। তবে তিনি বলেন, রেশনিং করে বিপর্যয় রোধ করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে।
পেজেশকিয়ান বলেন, “যদি রেশনিং কাজ না করে, আমরা হয়তো তেহরান খালি করতে বাধ্য হব।”
তার মন্তব্য ইরানি বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় তুলেছে।
তেহরানের সাবেক মেয়র গোলামহোসেন কারবাশি এই ধারণাটিকে ‘একটি রসিকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, “তেহরান খালি করার কোনো অর্থ নেই।”
ইরানের আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ১০ দিনেও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এদিকে, তেহরানের দৈনন্দিন জীবন ইতোমধ্যে পানি সংকটে প্রভাবিত হচ্ছে।
তেহরানের এক নারী বিবিসিকে বলেন, “আমি টয়লেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য পানির ট্যাংকার কেনার পরিকল্পনা করছি।”
গত গ্রীষ্মে ইরানি র্যাপার ভাফা আহমদপুর সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন, যেখানে দেখা যায় রান্নাঘরের কল থেকে পানি বের হচ্ছে না।
তিনি বলেছিলেন, “চার বা পাঁচ ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমি শুধু টয়লেটে যাওয়ার জন্য বোতলজাত পানি কিনেছি।”
জলাধার প্রায় খালি
তেহরানের প্রধান জলাধারের মধ্যে একটি হলো লাতিয়ান বাঁধ। ওই বাঁধের ব্যবস্থাপক জানান, বর্তমানে এর ধারণক্ষমতার ১০ শতাংশেরও কম পানি আছে। নিকটবর্তী কারাজ বাঁধের অবস্থাও ভয়াবহ। এই বাঁধ তেহরান ও আলবোরজ প্রদেশে পানি সরবরাহ করে।
স্থানীয় এক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেন, “আমি জন্মের পর থেকে কখনো এই বাঁধকে এত খালি হতে দেখিনি।”
কারাজ বাঁধের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ-আলী মওল্লেম জানান, বৃষ্টিপাত অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, “গত বছরের তুলনায় বৃষ্টিপাত ৯২ শতাংশ কমেছে। আমাদের জলাধারে মাত্র ৮ শতাংশ পানি আছে। আর তারও বেশির ভাগ ব্যবহারযোগ্য নয়।
পানীয় সংকটের শঙ্কা
সরকার এখন শীতকাল শেষের বৃষ্টির ওপর ভরসা করছে, কিন্তু পূর্বাভাস আশাব্যঞ্জক নয়। ইরানের জ্বালানি ও পানি মন্ত্রী আব্বাস আলী আবাদি সতর্ক করেছেন, পরিস্থিতি শিগগিরই কর্তৃপক্ষকে পানির সরবরাহ সীমিত করতে বাধ্য করতে পারে।
তিনি বলেন, “রাতে আমাদের পানির প্রবাহ শূন্যে নামিয়ে দিতে হতে পারে।”
কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত পানি ব্যবহারকারী পরিবার ও ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছে।
পাইপ, যুদ্ধের ক্ষতি এবং সংকটের বিস্তার
ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী আলী আবাদি জানিয়েছেন, তেহরানের পানি সংকট কেবল বৃষ্টির অভাবের কারণে নয়। তিনি রাজধানীর শতবর্ষী অবকাঠামোর কারণে পানি অপচয়কে দায়ী করেছেন। পাশাপাশি তিনি ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কথাও তুলে ধরেছেন।
১৫ জুন তেহরানের উত্তরাঞ্চলীয় তাজরিশ এলাকায় ইসরায়েল বিমান হামলা চালায়। হামলার পর ভিডিওতে দেখা যায় এলাকাটি প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পরের দিন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, তারা ইরানি সামরিক “কমান্ড সেন্টার“ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল।
কিন্তু পানি সংকট শুধু রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ নয়।
ইরানের জাতীয় জলবায়ু ও খরা ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের প্রধান আহমদ বাজার সতর্ক করেছেন, তেহরান ছাড়াও অন্যান্য প্রদেশ- যেমন পশ্চিম আজারবাইজান, পূর্ব আজারবাইজান ও মার্কাজিতেও পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে মাশহাদেও কর্মকর্তারা সতর্কতা জারি করছেন। উত্তর-পূর্ব ইরানের খোরাসান রাজাভি প্রদেশের গভর্নর জানিয়েছেন, মাশহাদের জলাধারের পানি “৮ শতাংশেরও কম“ হয়ে গেছে এবং প্রদেশের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘদিনের সংকট
ইরানের পানি সংকট বহু দশক ধরেই তৈরি হচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বারবার এই সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। ২০১১ সালে নববর্ষের ভাষণে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় পানি সংকট নিয়ে তিনি কথা বলেছেন।
তবে পরিবর্তন খুব একটা আসেনি। আজ, তেহরান, কারাজ ও মাশহাদ মিলিয়ে ১৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস করছে। তারা পানি ফুরিয়ে যাওয়ার বাস্তব সংকটের মুখোমুখি।
পালাবদল/এমএম