
মোগাদিসুর একটি সমুদ্র সৈকত। ছবি: আনটেমড বর্ডার্স
গত কয়েক দশক ধরে সোমালিয়া নামটি ছিল সংঘাত, জলদস্যু আর বিপদের প্রতিশব্দ। নব্বই দশকে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর ব্যাপক হারে কমে গিয়েছিল পর্যটক, বিশেষ করে পশ্চিমা পর্যটকের সংখ্যা। তবে সাম্প্রতিককালে দেশটিতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
সোমালিয়ার পর্যটন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে প্রায় ১০ হাজার পর্যটক দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন। যা আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। অবশ্য বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ এখনো তাদের নাগরিকদের দেশটিতে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেয়।
সোমালিয়া গঠিত মূলত তিনটি প্রধান অঞ্চল নিয়ে-মোগাদিসু, সোমালিল্যান্ড ও পুন্তল্যান্ড। এর মধ্যে স্বশাসিত সোমালিল্যান্ড পর্যটকদের জন্য প্রায় শতভাগ নিরাপদ। পুন্তল্যান্ড ও মোগাদিসুতে এখনো রয়ে গেছে নিরাপত্তা শঙ্কা।
এরপরও কীভাবে ভয়ংকর এ দেশটির কীভাবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে-তা উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যম সিএনএন এর প্রতিবেদনে।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরের আয়োজন করে আনটেমড বর্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে মাত্র ২টি গ্রুপ ট্যুর আয়োজন করতে পেরেছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরের বছর ২০২৪ সালে দেশটিতে তারা গ্রুপ ট্যুর আয়োজন করে ১৩টি। আনটেমড বর্ডার্সের প্রতিষ্ঠাতা জেমস উইলকক্স সিএনএনকে বলেন, 'সোমালিয়ায় পর্যটকদের ভ্রমণ চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।'
ভ্রমণ প্রক্রিয়া সহজ ও পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটি নতুন ই-ভিসা চালু করেছে। তবে সোমালিয়া এখনো বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে পরিচিত।
দেশটির মানবিক সংকট এখনো ভয়াবহ। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানায়, সংঘাত, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জলবায়ুজনিত দুর্যোগে ২০২৪ সালে সোমালিয়ার ৫ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর আগে বাস্তুচ্যুত হন আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। জলদস্যুতা কিছুটা কমলেও এখনো গালফ অব এডেন ও ভারত মহাসাগরে এ হুমকি রয়েছে।
সোমালিয়ায় ভ্রমণ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান
যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস দেশটিকে রেখেছে 'অপহরণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' তালিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোমালিয়াকে রেখেছে 'স্তর ৪: ভ্রমণ করবেন না' তালিকায়। কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছে-অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, অস্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, অপহরণ, জলদস্যুতা ও নিয়মিত কনসুলার সেবার অভাবকে।
বাস্তবতা হলো, সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আল শাবাব এখনো সোমালিয়ার বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়। ২০২৫ সালের শুরুতেও মোগাদিসুতে তারা কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলা চালায়।
তাহলে কেন পর্যটকরা দেশটির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন!
সিএনএনকে উইলকক্স বলেন, “আমার মাধ্যমে সোমালিয়ায় আসা বেশিরভাগ পর্যটকই চরম অভিজ্ঞতা খোঁজে আসা। আনটেমড বর্ডার্স পরিচালিত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গন্তব্য মোগাদিসু।”
দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেমস উইলকক্স কোনো বড় ঘটনা ছাড়া মোগাদিসুতে ট্যুর আয়োজন করেছেন। তিনি বলেন, “হামলার ঝুঁকি বাস্তব। বিদেশি পর্যটকরা যেখানে থাকতে পারেন, সেসব জায়গাই সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু। মোগাদিসুতে এলে আপনি আড়ালে যেতে পারবেন না।”
সোমালিয়ায় আগের সময়ের চলা তীব্র সংঘাত অনেকটাই কমেছে। এই তুলনামূলক স্থিতিশীলতার সুযোগ নেন যুক্তরাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত পয়োনিষ্কাশন প্রকৌশলী পিটার বুলক। আফ্রিকার ৫২টি দেশ ঘুরে দেখার অভিযাত্রায় আনটেমড বর্ডার্সের ব্যবস্থাপনায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে সোমালিয়া আসেন তিনি।
সশস্ত্র প্রহরায় বুলক শহরের মাছের বাজার, উপকূলীয় এলাকা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্যাথেড্রাল ঘুরে দেখেন। সিএনএনকে তিনি বলেন, 'স্বীকার করতেই হবে, এ অভিজ্ঞতা আমার আগের যেকোনো ভ্রমণের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। আমি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পছন্দ করি। তবুও মোগাদিসু আমার কাছে অনিরাপদ মনে হয়নি।'
তিনি আরও বলেন, “সোমালিয়া ছাড়ার সময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ছিল চমৎকার। সবকিছু খুব মসৃণভাবে সম্পন্ন হয়। লন্ডনেও হিথ্রো বিমানবন্দরের চেয়েও এটি ছিল অনেক বেশি মনোরম।”
দেশটিতে ভ্রমণের বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে উইলকক্স বলেন, “সোমালিয়ার কিছু অংশ অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে কোনো বিদেশির যাওয়া অত্যন্ত বোকামি হবে।”
সোমালিল্যান্ড- দেশটির অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র
সোমালিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থানরত স্বঘোষিত রিপাবলিক অব সোমালিল্যান্ড ১৯৯১ সাল থেকে স্বশাসিত। নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী, নির্বাচিত সরকার ও মুদ্রা নিয়ে এটি বৃহত্তর সোমালিয়ার মধ্যে 'সবচেয়ে নিরাপদ' ভ্রমণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
সোমালিয়া বা মোগাদিসুর তুলনায় এখানকার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সোমালিল্যান্ডের প্রথম দিকের নারী ট্যুর গাইডদের একজন হলেন ডেকে হাসান আবদি।
সিএনএনকে আবদি বলেন, “মানুষ সোমালিয়া ভেবে সোমালিল্যান্ড সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা পোষণ করেন। অনেকেই ভাবেন সোমালিল্যান্ড নিরাপদ না। যা সত্য নয়। তাই পর্যটন আমাদের আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।”
সোমালিল্যান্ডের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চান আবদি। বলেন, “সোমালিল্যান্ড পর্যটকদের এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা উপহার দেয়। ভিন্ন কিছু খুঁজছেন এমন পর্যটকদের জন্য এই জায়গাটি আদর্শ। প্রাচীন পাথর শিল্প, যাযাবর সংস্কৃতি ও নির্মল সৈকত রয়েছে এখানে।”
আবদি বলেন, “আমি পর্যটকদের সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসার স্থানীয় বাজারে নিয়ে যেতে ভালোবাসি। আমি তাদের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তারা দেখেন, আমাদের মানুষরা কতটা আন্তরিক, আর শহরে কোনো প্রহরী ছাড়াই কতটা নিরাপদে হেঁটে বেড়ানো যায়।”
অবশ্য হারগেইসার বাইরেই মোগাদিসুর সঙ্গে সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে যেতে পর্যটকদের সশস্ত্র পুলিশ প্রহরার প্রয়োজন হয়। এই অঞ্চলটিকে নাগরিকদের জন্য 'নো-গো' অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে পশ্চিমা দেশগুলো। ২০১৩ সাল থেকে এখানেই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন লুপিন ট্রাভেল এর প্রতিষ্ঠাতা ডিলান হ্যারিস।
সোমালিল্যান্ডকে মোগাদিসুর চেয়ে নিরাপদ আখ্যা দিয়ে হ্যারিস সিএনএনকে বলেন, “সোমালিল্যান্ডের বড় আকর্ষণ হলো লাস গিলের ৫ হাজার বছর পুরোনো গুহাচিত্র। এছাড়া বন্দরনগরী বারবেরার পরিত্যক্ত জাহাজগুলোও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।”
হ্যারিস আরও বলেন, “সোমালিল্যান্ডের অধিকাংশ জায়গায় পর্যটকরা সহজে ভ্রমণ করতে পারেন। এজন্য বর্তমানে সোমালিয়ায় ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।”
আনটেমড বর্ডারসের সঙ্গে দুই অঞ্চলেই গিয়েছেন ক্লেয়ার মেকিন। তিনিও হ্যারিসের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত।
মোগাদিসুতে নিরাপত্তাজনিত বিধিনিষেধের কারণে মেকিন স্থানীয়দের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতেন না। সিএনএনকে মেকিন বলেন, “পর্যটকদের আগ্রহের তালিকায় সোমালিয়ার আগে সোমালিল্যান্ড জায়গা করে নেবে। এখানকার স্থানীয় মানুষরা অত্যন্ত আন্তরিক। তারা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, আমরা তাদের দেশে ভ্রমণ করতে এসেছি।”
মেকিন বলেন, “সোমালিয়াও ভ্রমণের জন্য ভালো জায়গা, তবে তা ভীরুদের জন্য নয়।”
২০২৫ সালের নভেম্বরে ইথিওপিয়ার ‘মোস্ট ট্রাভেলড পিপলস সামিট’ আয়োজিত হয়। এই সামিটে অংশ নেওয়া পর্যটকরা কঠিন বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন। বিশ্বের সবকটি দেশে ঘোরা তাদের বাকেট লিস্টের অংশ। ওই সামিটের সময়ের সঙ্গে মিল রেখে আনটেমড বর্ডারস এবং লুপিন ট্রাভেল মোগাদিসুতে বেশ কয়েকটি ট্যুরের আয়োজন করতে সক্ষম হয়।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
তবুও নিকট ভবিষ্যতে সোমালিয়ায় পর্যটকদের আগমনের হার সীমিত পরিসরে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। নতুন ই-ভিসা চালু হওয়া সত্ত্বেও দেশের পর্যটন কাঠামো এখনো ভাঙা-চোরা। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতি এখনো কেবল মোগাদিসু আগমনকারীদের জন্যই প্রযোজ্য। সোমালিল্যান্ড ও আরেকটি স্বশাসিত অঞ্চল পুন্তল্যান্ড এই ই-ভিসা এখনো গ্রহণ করেনি।
তবুও আশাবাদী উইলকক্স। তিনি বলেন, “বছরের পর বছর ধরে আমি বিভিন্ন দেশে ই-ভিসা সিস্টেম চালু হতে দেখেছি। যেমনটা পাকিস্তান এবং তাজিকিস্তান। আমরা সেখানেও কাজ করি। তবে এখন পর্যন্ত সোমালিয়ার ই-ভিসাটিই সেরা। এর চেয়ে ভালো বাস্তবায়ন আর কেউ করেনি।”
এরই সুফল হিসেবে বেশ কয়েকটি ট্যুর সফলভাবে শেষ করেন উইলকক্স। এভাবেই একসময়ের ভয়ংকর সোমালিয়া ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে পর্যটকদের আগ্রহের জায়গা।
পালাবদল/এসএ