
জোহরান মামদানি। ছবি: রয়টার্স
বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ার পরপরই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা ‘বাম সাম্রাজ্য’। সেই ঘটনা ১৯৯০ দশকের। তারপর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে বয়ে চলছে ‘দখিনা হাওয়া’। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত সমাজবাদের ওপর চেপে বসে ডান বা দক্ষিণ-ধারার রাজনীতি। বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাপী এই ডানপন্থিদের বাড়বাড়ন্ত, বিজয় ও ব্যর্থতা দেখেছে। আরও দেখেছে ডানপন্থার ওপর চেপে বসা অতি ডান বা উগ্র ডানপন্থার আস্ফালন।
দেশে দেশে সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলেছে ডান বা দক্ষিণ-ধারার রাজনীতি। মানুষকে শুধু মুক্ত করার স্বপ্ন নয়, মুক্ত হাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকরা। এখন অনেকে তাদের রাজনীতির ভাগ্যাকাশে যেন দেখতে পাচ্ছেন সিঁদুরে মেঘ। একে 'মামদানি মেঘ' বললে আশা করি বেশি বলা হবে না।
নিউইয়র্ক মহানগরীর মেয়র হিসেবে ৩৪ বছর বয়সী জোহরান মামদানির বিজয় একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে যেমন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সৃষ্টি করেছে অনুপ্রেরণা।
জোহরান মামদানির বিজয়ের পরদিন তথা গত ৫ নভেম্বর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়-মামদানির বিজয়ে বিশ্বব্যাপী বামপন্থিরা উজ্জীবিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল ও পরিশেষে, তার বিজয় দেখে বিশ্বব্যাপী বামঘেঁষা রাজনীতিক ও কর্মীরা আনন্দিত। তারা জোহরান মামদানির আত্মপরিচয় নিয়ে স্পষ্টবাদিতা এবং সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার ঘটনা দেখে অনুপ্রাণিত।
জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ভোটে রেকর্ড-গড়া জয় পেয়েছেন। তিনি বিজয়ী হয়ে বিজয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেইসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি ক্রমাগত শ্রমিক শ্রেণির সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের চলাফেরার সুব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। আর তারাও তাকে ভোট দিয়েছেন 'বাক্স ভরে'।
জোহরান মামদানি তার শহরে ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর কথা বলেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। তার শহরে 'অতি ধনীর প্রয়োজন নেই' বলেও সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন নির্ভয়ে।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়-জোহরান মামদানির বিজয়ে বিদেশ থেকে বামপন্থি সংগঠন ও রাজনীতিকরা শুভেচ্ছা ও সহমর্মিতা জানিয়েছেন। তার বিজয়ে আশাবাদী হয়েছেন গণমানুষের কল্যাণ নিয়ে ভাবা ব্যক্তিরা। ডানপন্থার জোয়ারে ভেসে যাওয়া বাম ভাবধারার মানুষেরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখছেন তার বিজয়ে।
জোহরান মামদানি শুধু আশা দেখাননি, দিয়েছেন দিক-নির্দেশনাও। তার বিজয়-উৎসারিত অনুপ্রেরণার আলো ক্রমশ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে বলেও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাজ্যের গ্রিন পার্টির এক উদীয়মান নেতা সম্প্রতি বলেছেন যে তিনি জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত। বাম ধারার অনেক রাজনীতিক জোহরান মামদানির বিজয়ে উল্লসিত।
দেশটির ক্ষমতাসীন মধ্য-বামপন্থি লেবার পার্টির নেতা ও লন্ডন মহানগরীর মেয়র সাদিক খানও সুদূর নিউইয়র্কের মেয়র পদে জোহরান মামদানির বিজয়ে 'আশাবাদী' হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রোষানলে পড়া লন্ডন-মেয়র আরও বলীয়ান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক-বিজয়ে।
লেবার পার্টির সাবেক প্রধান জেরেমি করবিন ব্রিটেনের নেতা হয়ে নিউইয়র্কের মেয়র প্রচারণার সময় জোহরান মামদানির পক্ষে অনলাইনে নিজের মত প্রকাশ করেছেন।
একই প্রতিবেদনে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ার বামপন্থি রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পের্তোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জোহরান মামদানির বিজয়ের সংবাদে উল্লসিত এই নেতা নির্বাচিত মেয়রের সঙ্গে নিজের ছবি সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
গুস্তাভোর দলের অপর নেতা মারিয়া হোসে পিজারো রদ্রিগেস টুইটে বলেন, “মামদানির বিজয়ে এটাই পরিষ্কার হলো যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি কোনো চরমপন্থা নয়, এটিই এখনকার বাস্তবতা।”
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ইহুদি-অধ্যুষিত নিউইয়র্কে দাঁড়িয়ে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন জোহরান মামদানি। তবুও নিউইয়র্কের মোট ইহুদি ভোটারের ৩০ শতাংশ জোহরান মামদানিকে ভোট দিয়েছেন বলে ভোট-জরিপে প্রকাশিত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, জোহরান মামদানির বিরুদ্ধে তার বিরোধীদের দেওয়া ‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ তকমা ভোটের বাক্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই হয়ত ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ জোহরান মামদানির বিজয় থেকে দেশটির বিরোধীদলগুলোর শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের উদারপন্থি মেয়র জেরজেলি কারাকসনি নিউইয়র্কের মেয়র জোহরান মামদানির প্রশংসা করেছে বলেছেন-এই ব্যক্তি ট্রাম্প, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট অভিজাতদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তার মতে, মামদানির নীতি স্বল্প আয়ের মানুষদের সেবা করা, ধনীদের নয়।
গত জুনে হাঙ্গেরির উগ্র ডানপন্থি সরকারের এই তীব্র সমালোচক ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান, তিনি আগ্রহ নিয়ে জোহরান মামদানি রাজনৈতিক উত্থান পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেসময় তিনি বলেছিলেন, “শত শত্রুতা সত্ত্বেও গণতন্ত্র কীভাবে সত্যিকার অর্থে কার্যকর হয়, তাই দেখছি।”
জোহরান মামদানির মা-বাবার দেশ ভারতেও আনন্দিত ক্ষমতাসীন উগ্র ডানপন্থি বিজেপি-বিরোধী দলগুলো। গত মে মাসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রে মোদিকে 'যুদ্ধাপরাধী' আখ্যা দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি নিজেকে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট বলে দাবি করা এই মার্কিন রাজনীতিক।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি নিউইয়র্কের এক মন্দিরে গিয়ে বলেন, “নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করছি কারণ তিনি ভারতের বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে এক ধর্মের মানুষদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন।”
তাই জোহরান মামদানির বিজয়ে বিজেপি বা মোদিভক্তরা খুশি না হলেও উৎফুল্ল দেশটির উদার গণতান্ত্রিক আদর্শের দলগুলো। সেখানকার গণমাধ্যমে বামপন্থিসহ সব মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা দলগুলো তাদের আশাবাদ ব্যক্ত করছে।
কট্টর বিজেপিবিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও লোকসভা সদস্য মহুয়া মৈত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, 'মামদানি শুধু নিউইয়র্ক জয় করেননি, তিনি আমাদের ভেতর আশা জাগিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে একজনের ভালোবাসা, সাহস ও সত্যবাদিতা দিয়ে বিজয় আনা যায়।'
একইদিনে, বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়-জোহরান মামদানির অভূতপূর্ব বিজয়ে ইউরোপের বামপন্থি দলগুলো উৎসাহ পেয়েছে। তারা মনে করছে যে, 'বৈপ্লবিক কর্মসূচি' নিয়ে নিজ নিজ দেশে ডানপন্থি সরকার বদলে দেওয়া সম্ভব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা জোহরান মামদানির বিজয়ে আশাবাদী হচ্ছেন। তারা ডানপন্থিদের ভয়ে নিজেদের গণমুখী কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন না। অভিবাসন নিয়ে তাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে চাচ্ছেন না।
জার্মানির বামপন্থি দলের নেতা জান ফান আকেন সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন, “নিউইয়র্কের মতো আমাদেরও একই ধরনের সমস্যা। এখানেও বাড়ি ভাড়া আকাশচুম্বী। এখানে নিত্যপণ্য, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, গণপরিবহনের খরচ নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু, সেই অনুপাতে মানুষের আয় বাড়ছে না।”
পালাবদল/এসএ