
সংগৃহীত ছবি
শাহেদ আলী (জন্ম: মে ২৬, ১৯২৫; মৃত্যু: ৬ নভেম্বর, ২০০১) আমাদের সাহিত্যে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য সংস্কৃতিতে রয়েছে তার ব্যাপক অবদান। বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন শক্তিশালী লেখক। বাংলা ভাষার জন্য তিনি ছিলেন একজন লড়াকু সৈনিক। তার বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানও রয়েছে ব্যাপক। তিনি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। তার জীবেনর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তার সাহিত্য কর্মে, তার জীবন দর্শনে। জীবনকে তিনি চলমান করেছেন সাহিত্যের মধ্যে।
বাংলা সাহিত্যে তার অবদানের প্রভাব ব্যাপক। তিনি একজন আলোচিত লেখকও। সমালোচিত হয়েছিলেন তার বিখ্যাত ‘জিবরাইলেরর ডানা’ গল্পের জন্য। এ গল্পের জন্য তাকে ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তবু তিনি দমে যাননি। সাহিত্যের প্রতি তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ছিল লক্ষ্যণীয়। যার জন্য সমালোচনার পরও তার হাত দিয়ে আমাদের সাহিত্যে যুক্ত হয়েছে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর অনেক গল্প। মূলত কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার পরিচিতি তাকে অনন্যতা দান করেছে।
তার ছোটগল্পগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক। গল্পগুলোতে রয়েছে মুন্সিয়ানার ছাপ। জীবনধর্মী গল্পকার হিসেবে আমরা তার গল্পগুলো পাই। তিনি জীবনকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তবতার আলোকে দেখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের একজন প্রাণপুরুষ। তার সাহিত্য কর্মগুলোতে দেখা যায় জীবনঘনিষ্ঠ পদচারণা, জীবনাচারের উপজীব্য। জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়াদি সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন সাহিত্যের মাধ্যমে। তিনি মানবিকতাকে মূল্যবোধের সাথে সমান্তরালে নিয়ে এগিয়েছে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন আদর্শবান মানুষ। আমরা তার প্রভাব তার সাহিত্যে পায়।
শাহেদ আলী ১৯৫১ সাল থেকে কর্মজীবন শুরু করেন। অধ্যাপনা দিয়ে তার শুরু। বেশ কয়েকটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি সাংবদিকতা করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন। সাহিত্যে ছিলেন একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত। তিনি আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে তার অবদান রয়েছে। তিনি ছিলেন আমাদের ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক। তিনি সেই ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই এই আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। এই সূত্র ধরে পরবর্তীতে এদেশে তমদ্দুন মজলিশ নামে যে সংগঠন গড়ে ওঠে তিনি ছিলেন তার সাধারণ সম্পাদক। পরে এর সভাপতিও হয়েছিলেন।
তিনি একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ছাড়াও সাংবাদিকতা, অনুবাদ কর্মে তিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। গবেষণায় তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জড়িত ছিলন। স¤পদনা করেছেন অনেক। একজন দক্ষ স¤পাদক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকল্প ইসলামী বিশ্বকোষের স¤পাদনা বোর্ডের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমী পত্রিকার স¤পাদনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাথে জড়িয়ে আছে তার জীবনের একটা বড় অংশ। এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি জড়িয়ে আছেন বিভিন্নভাবে। সে সবের পিছনে তার সক্রিয় অবদান রয়েছে। এই ফাউন্ডেশনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হলে তখন এটা ছিল ইসলামী একাডেমী। তিনি দীর্ঘদিন ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকে প্রকাশিত মাসিক সবুজ পাতা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়টাতে তিনি ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলনের দায়িত্বে ছিলেন।
একজন ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবেও তিনি ছিলেন সুপরিচিত। ইসলামী চিন্তা দর্শন নিয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তিনি খেলাফতে রব্বানী পার্টি নামে একট দলের সাথে জড়িত ছিলেন এবং সেই পার্টি থেকে নমিনেশ নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে ১৯৫৪ সালে আইন সভার সদস্য হয়েছিলেন।
শাহেদ আলীর ৫০টির মতো গ্রন্থ রয়েছে। গল্পগ্রন্থ হলো, জিবরাইলের ডানা, একই সমতলে, শা’নযর, অতীত রাতের কাহিনী, অমর কাহিনী, নতুন জমিনদার এর মতো গল্পগ্রন্থ রয়েছে। লিখেছেন তিনটি উপন্যাস: হৃদয় নদী, কাদা মাটির সাতকাহন, আÍসমর্পণ।
প্রবন্ধ-গবেষণার মধ্যে রয়েছে, একমাত্র পথ, তরুণ মুসলিমের ভূমিকা, ফিলিস্তীনে রুশ ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া, তরুণের সমস্যা, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান, তাওহীদ, বুদ্ধির ফসল আত্মার আশিষ, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা, Economics Order Of Islam, জীবন নিরবচ্ছিন্ন, Islam in Bangladesh, জীবনদৃষ্টি, ইত্যাদি। শিশুদের উপযোগী বইয়ের মধ্যে আছে, রুহীর প্রথম পাঠ, ছোটদের ইমাম আবু হানিফা, সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ।
‘জীবনকথা‘ নামে তার একটি আত্মজীবনী রয়েছে। একটাই নাটিকা লিখেছেন, ‘বিচার’ নামে।
প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি গল্প লিখতেন। ভাষা সাহিত্যে তার ব্যাপক দখল থাকায় সাহিত্য কর্ম ও সাহিত্যের মান সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। অধ্যাপনাও করেছেন বাংলা সাহিত্যের উপর। যার ফলে সামগ্রিকভাবে সাহিত্যে প্রতি ছিল তার স্বচ্ছ ধারনা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণে তার অনুবাদকর্মও ছিল প্রাঞ্জল।
অনুবাদ কর্মে তিনি অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন। তার হাত দিয়ে অনুবাদ হয়েছে মুহাম্মাদ আসাদের বিখ্যাত বই ‘মক্কার পথ’। আসাদের ‘ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি’ বইও তিনি অনুবাদ করেন। ইতিহাসের উপর প্রথম লিখিত বই হিরোডাটাস এর ‘ইতিবৃত্ত’ তিনি অনুবাদ করেন এবং তা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন কে বি এইচ কোনান্টের ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ’ ও ইমাম শামেলির ‘ককেশাসের মহানায়ক’ বই।
শাহেদ আলী আমাদের একজন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক। আমাদের সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার। সাহিত্যে তার মুন্সিয়ানা ও পাণ্ডিত্য আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি সাহিত্য করেছেন নিরলসভাবে। তার জীবন বিশ্বাসে আদর্শবাদীতার স্থান ছিল। তার ব্যাপক প্রভাব আমরা তার সাহিত্যে লক্ষ করি। সাহিত্যের তার অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি তার সময়ের একজন প্রধান সাহিত্যিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন মূল্যবান সম্পদ।
সামগ্রিকভাবে আমরা তার বহুমুখী প্রতিভা লক্ষ্য করি। তবুও শাহেদ আলীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা কার্যকর দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। তার অবদানের গুরুত্ব উপলব্ধিতে আমাদের হীনদৃষ্টি হয়ত এর পিছনের কারণ। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পাক্ষপাতিত্ব তার মতো একজন গুণী মানুষকেও দূরে সরিয়ে রেখেছে। আমরা তার অবদানকে স্বীকার করতে হীনম্মন্যতায় ভুগি। আমাদের অন্তরে দীনতা রয়েছে। এ বছরই তার জন্ম শতবর্ষ পূর্তি হয়েছে। আশা করা যায় তার সাহিত্য ও রেখে যাওয়া কর্ম অমূল্য হয় থাকবে।