
সংগৃহীত ছবি
গত ২০০ বছরে দুইবার যুদ্ধে জড়িয়েছিল চীন ও জাপান। এই দুই প্রভাবশালী প্রতিবেশীর প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল ১৮৯৪ সালে এবং তা চলেছিল প্রায় এক বছর। তখন পশ্চিমের প্রযুক্তিতে বলিয়ান জাপান ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের তুলনায় বেশ শক্তিশালী।
দেশ দুইটির মধ্যে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। তা চলেছিল ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। সেই সময় অপেক্ষাকৃত দুর্বল মহাচীন ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর অংশ। আর শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল সেই সময়কার মহাশক্তিধর জাপানকে।
সেই মহাযুদ্ধের পর পরিবর্তিত পৃথিবীতে পাল্টে যায় চীন-জাপানের সম্পর্কও।
গত দুই শতকে দুইবার বড় যুদ্ধের পর নতুন শতাব্দীর প্রথমার্ধে আবারও কেন “যুদ্ধে“ জড়াচ্ছে এখনকার জাপানের তুলনায় অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বহুগুণ শক্তিশালী চীন?
গত ১৮ নভেম্বর বিবিসি-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়-তাইওয়ান নিয়ে চীন ও জাপানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনা সম্পর্কে যা জানা দরকার।
এতে বলা হয়, নভেম্বরের প্রথমদিকে জাপানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি বলেছিলেন, চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে তাহলে জাপান নিজের নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে এর মোকাবিলা করতে পারে।
এর প্রতিক্রিয়ায় চীনের এক কূটনীতিক যা বলেছিলেন তা অনেকটা হুমকির মতো শুনিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
প্রতিবেদন অনুসারে, শুরুতে যা বাকযুদ্ধ ছিল পরে তা আরও বিস্তৃতি লাভ করে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একে অপরের বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ পাঠাতে শুরু করেন। প্রভাব পড়ে পর্যটন ও বাণিজ্যে। তাতেও উত্তেজনা কমেনি।
জাপান তার নাগরিকদের চীন সফরে সতর্ক থাকতে বলে। বিপরীতে, চীন তার নাগরিকদের জাপান সফর এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়। শুধু তাই নয়, কয়েকটি চীনা এয়ারলাইনস পর্যটকদের টিকিট ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
অন্যদিকে, উত্তেজনার পারদ এতটাই ওপরে যে দুইটি জনপ্রিয় জাপানি চলচ্চিত্র চীনে মুক্তি দেওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়েছে।
বিবিসি-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীন ও জাপানের শত্রুতা ঐতিহাসিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়াও, স্ব-শাসিত তাইওয়ান দ্বীপের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ‘কৌলশগত ধোঁয়াশা’ও নতুন উচ্চতা পেয়েছে।
বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত বলা যাক। ঘটনাটির জন্ম গত ৭ নভেম্বর, জাপানে। দেশটির পার্লামেন্টারি বৈঠকে এক বিরোধী আইনপ্রণেতা নতুন প্রধানমন্ত্রী তাকাইচির কাছে জানতে চান-তাইওয়ান কীভাবে জাপানের জন্য হুমকি হতে পারে।
জবাবে তাকাইচি বলেন, “তারা যদি শক্তি প্রয়োগ করে তাহলে সার্বিক পরিস্থিতি জাপানের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তো বটেই।”
তার এমন মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয় বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একে “ভয়াবহ“ বক্তব্য হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ঘটনার পরদিন জাপানের ওসাকা শহরে চীনের কনসাল জেনারেল সমাজমাধ্যম এক্স-এ জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেয়ার করেন। সঙ্গে জুড়ে দেন নিজের মন্তব্যও।
কনসাল জেনারেল বলেন, “যে নোংরা মাথা নিজেকে আটকে রেখেছে তা অবশ্যই কেটে ফেলতে হবে।”
এই কথার মাধ্যমে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছে তা হয়ত অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু, এমন মন্তব্যকে ‘অত্যন্ত অনুপযুক্ত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাপানের চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি।
এরপর শুরু হয়ে যায় দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ের‘কথা ছোড়াছুড়ি’। চীনা কূটনীতিকের কথার প্রতিবাদ জানায় জাপান; আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিবাদ জানায় চীন।
২০১৫ সালে জাপানের নিরাপত্তা আইনে ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি পরিস্থিতি’ শব্দগুচ্ছ যোগ করা হয়। এর মাধ্যমে বহিঃশত্রুর আক্রমণের কথা বোঝানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে জাপান তার নিরাপত্তা বাহিনীকে আগ্রাসন ঠেকাতে ডাকবে বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়।
যা হোক, জাপানের প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্য তুলে নেওয়া তো দূরের কথা তা বারবার প্রচার করে যাচ্ছেন। আবার চীনের কনসাল জেনারেলের এক্স-বার্তা সরিয়ে ফেলা হলেও, “উত্তেজনা“ কমেনি।
এরইমধ্যে, জাপানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বেইজিং। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে নেওয়ার দাবি জানায়।
সমাজমাধ্যমে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাপানকে ‘আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ’ করতে সতর্ক করেন। চীন ও তাইওয়ান নিয়ে জাপান “মাথা ঘামালে“ তা আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
পাশাপাশি, তাইওয়ান নিয়ে ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দেওয়ায় চীন তার নাগরিকদের আগামী দিনগুলোয় জাপান ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে। এমন আহ্বানে জাপানের পর্যটন খাত ও বাজার পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। কেননা, প্রতিবছর চীনের লাখো পর্যটক জাপানে আসেন।
তবে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাইওয়ান সমস্যা সমাধানের বিষয়ে জাপানের নীতির পরিবর্তন হয়নি বলে টোকিও থেকে বলা হচ্ছে। আবার সেই চীনা কনসাল জেনারেলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হচ্ছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বিবিসি-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাপানের ভূমিকায় চীনারা নাখোশ হওয়ায় দুইটি জাপানি চলচ্চিত্র চীনে আপাতত মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। চীনের সিসিটিভি-এর বরাত দিয়ে বিবিসি-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জনপ্রিয় জাপানি অ্যানিমেশন মুভি “ডিমন স্লিয়ার: ইনফিনিটি ক্যাসল“-এর টিকিট বিক্রি চীনে কমেছে।
একইদিনে অপর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-এর শিরোনাম করা হয়-ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে হাজারো চীনা পর্যটক জাপান সফর বাতিল করলেন।
‘জাপানে যত পর্যটক আসেন তাদের মধ্যে চীনাদের অবস্থান দ্বিতীয়’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়-টিকিট কেনার পরও জাপান সফর বাতিল করায় চীনা পর্যটকদের কোনো কড়ি গুণতে হয়নি। আরও বলা হয়, তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ অন্তত সাতটি চীনা এয়ারলাইনস বলেছে-কেউ টিকিট বাতিল করলে কোনো জরিমানা দিতে হবে না।
ভ্রমণ বিশেষজ্ঞ হানমিং লি বলেছেন, গত ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর জাপানমুখী প্রায় পাঁচ লাখ টিকিট বাতিল হয়েছে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর চাপে জাপান এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে বেইজিং পাঠিয়েছেন বিবদমান পরিস্থিতি সামাল দিতে।
চীনের জিমু নিউজের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান আরও জানায়, আগামী জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সিচুয়ান এয়ারলাইনস চীনের চেঙডু থেকে জাপানের সাপ্পোরোর মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। অর্থাৎ, বিষয়টি এখনই সুরাহার সম্ভাবনা নেই।
জাপানের সরকারি সংবাদমাধ্যম এনএইচকে-এর বরাত দিয়ে গত ১৯ নভেম্বর আল জাজিরা জানায়, কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে চীন প্রতিবেশী জাপান থেকে সব ধরনের সি ফুড আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়, গত ১৮ নভেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস জানায়, জাপান বলেছে তাইওয়ানের কাছাকাছি তাদের ইয়োনাগুনি দ্বীপের সন্নিকটে সন্দেহভাজন চীনা ড্রোন দেখে জাপানি যুদ্ধবিমানগুলো ফিরে এসেছে।
গত ১৭ নভেম্বর দ্য গার্ডিয়ান-এর অপর প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপান প্রায় ৫০ বছর তাইওয়ানকে নিজেদের দখলে রেখেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর দ্বীপটি টোকিওর হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে জাপান চায় না সেই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ এক ‘বৈরী রাষ্ট্রের’ হাতে যাক।
গত ২০ নভেম্বর দ্য জাপান টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ গ্লাস বলেছেন যে চীনের সঙ্গে জাপানের যেকোনো দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে সমর্থন দেবে।
তবে দীর্ঘ ৮৮ বছর পর চীন ও জাপানকে মুখোমুখি দেখা যাওয়ায় অনেকেই শঙ্কিত।
পালাবদল/এসএ