
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বশ করতে বিরল খনিজের ‘ঘুষ’! চীনকে সামনে রেখে রাশিয়াকে ব্যবহার। আর ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে ন্যাটো ধাঁচের প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলা। একের পর এক কূটনৈতিক চালে ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’দের থেকে ভারতকে আলাদা করে ফেলছে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির এ-হেন একঘরে দশায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। পাশাপাশি, ইসলামাবাদের ‘বাড়বাড়ন্তে’ কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিদেশনীতি এখন ভঙ্গুর বলে সমালোচনা করেছেন তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পাক বিমানবাহিনী দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পেতে চলেছে, দিন দুয়েক আগে এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বলা হয়েছে, ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীকে ‘এআইএম-১২০ অ্যাডভান্স মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার-টু-এয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র বা অ্যামরাম সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি হাতে পেলে মাঝ-আকাশের ‘ডগফাইট’-এ রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা যে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন, তা বলাই বাহুল্য। শুধু তা-ই নয়, এর জন্য যুদ্ধের সময় একাধিক লড়াকু জেট হারাতে হতে পারে ভারতকে।
জনপ্রিয় পাক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ জানিয়েছে, সম্প্রতি অস্ত্র রফতানি নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দফতর (আগে নাম ছিল প্রতিরক্ষা দফতর)। সেখানে ‘এইম-১২০ অ্যামরাম’-এর ক্রেতার তালিকায় ইসলামাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করেছে ওয়াশিংটন। দীর্ঘ দিন ধরেই আমেরিকার তৈরি এফ-১৬ লড়াকু জেট ব্যবহার করছে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির বিমানবাহিনী। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটিকে রাওয়ালপিন্ডির বিমানবাহিনীর শিরদাঁড়া বললে অত্যুক্তি হবে না। সেগুলিকে ওই ক্ষেপণাস্ত্র সাজিয়ে তোলা হবে বলে জানা গিয়েছে।
‘এইম-১২০ অ্যামরাম’-এর নির্মাণকারী সংস্থা হলো রেথিয়ন। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির সি৮ এবং ডি৩ ভ্যারিয়েন্ট তৈরির বরাত পেয়েছে তারা। এর জন্য ৪ কোটি ১৬ লক্ষ ডলার খরচ করবে ট্রাম্প প্রশাসন। অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির রফতানির তালিকায় পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় অতিরিক্ত ২৫১ কোটি ডলারের ওয়াশিংটনের কোষাগারে আসার সম্ভাবনা প্রবল। ইসলামাবাদ ছাড়া আমেরিকার থেকে ‘এইম-১২০ অ্যামরাম’ পাচ্ছে তুরস্ক এবং সৌদি আরবও। এই দুই দেশের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে নয়াদিল্লির পশ্চিমের প্রতিবেশীর।
চলতি বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে সেখানকার যুদ্ধ দফতরের মূল কার্যালয় পেন্টাগনের কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন পাক বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জহির আহমেদ বাবর। সূত্রের খবর, ওই সময়ই সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি সরবরাহের রাস্তা পাকা করে ফেলেন তিনি। ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী কত সংখ্যায় ‘অ্যামরাম’ পাবে তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। আমেরিকা এর সি৮ ভার্সানটি মূলত রফতানি করে থাকে বলে জানা গিয়েছে। তবে মার্কিন এবং ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর হাতে আছে ডি৩ ভ্যারিয়েন্ট, যা তুলনায় বেশি শক্তিশালী।
এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যবাহী ‘শ্বেতপ্রাসাদ’-এ (হোয়াইট হাউস) ট্রাম্পের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সেখানকার সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। এর পরই হাতিয়ার সরবরাহ করে ইসলামাবাদের হাত শক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সেই সহযোগিতার অঙ্গ হিসাবে রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা ‘এইম-১৩০ডি৩’ মাঝারি পাল্লার আকাশ থেকে আকাশ (এয়ার-টু-এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্র পেতে চলেছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
সূত্রের খবর, বর্তমানে পাক বিমানবাহিনী মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রটির সি৫ ভ্যারিয়েন্ট ব্যবহার করছে। দিন হোক বা রাত, যেকোনো সময়, যেকোনো আবহাওয়ায় নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে ‘অ্যামরাম’-এর। ১৯৯১ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ব্যবহার করছে মার্কিন বায়ুসেনা। ১২ ফুট লম্বা মারণাস্ত্রটি ২০ কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক বহনে সক্ষম। ইসলামাবাদ যে শ্রেণিটি পেতে চলেছে, তার পাল্লা ১৩০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে বলে জানা গিয়েছে। অর্থাৎ ‘অ্যামরাম’-এর সাহায্যে দৃষ্টিশক্তির বাইরে হামলা চালাতে পারবেন যোদ্ধা পাইলট।
সব কিছু ঠিক থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি হাতে পাবে পাক বিমানবাহিনী। এই পরিস্থিতিতে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ইসলামাবাদকে ‘আরডি-৯৩এমএ’ নামের লড়াকু জেটের একটি ইঞ্জিন ভারতের ‘বন্ধু’ রাশিয়া সরবরাহ করছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি’ নামের সাড়ে চার প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করছে ইসলামাবাদ। ওই লড়াকু জেটে নাকি মস্কোর ইঞ্জিন ব্যবহারের পরিকল্পনা করছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা, যা নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
গত শতাব্দীতে আমেরিকার সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলাকালীন ‘আরডি-৩৩’ নামের একটি টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন তৈরি করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর নির্মাণকারী সংস্থা ক্লিমভ। ১৯৭৪ সালে জন্মের পর বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধবিমানে এই ইঞ্জিনটির বহুল ব্যবহার করতে থাকে মস্কো। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন নির্মাণের লাইসেন্স পায় ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থা ‘হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যাল। বর্তমানে বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা ‘আরডি-৯৩এমএ’ এই ‘আরডি-৩৩’-এর উন্নত সংস্করণ বলে জানা গিয়েছে।
রুশ লড়াকু জেট মিগ-২৯, মিগ-৩৩ এবং মিগ ৩৫-এর মতো ‘মাল্টিরোল’ যুদ্ধবিমানগুলিতে রয়েছে ক্লিমভের ‘আরডি-৯৩এমএ’ ইঞ্জিন। এর মধ্যে প্রথম লড়াকু জেটটি ব্যবহার করছে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং নৌসেনা। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনটি চীনকে সরবরাহ করেছে মস্কো, যা শেনইয়াং এফসি-৩১ নামের যুদ্ধবিমান নির্মাণে কাজে লাগিয়েছে বেজিং। সূত্রের খবর, লড়াকু জেটকে বিদ্যুৎগতি দিতে ৯১.২ কিলো নিউটনের শক্তি জোগানোর ক্ষমতা রয়েছে ‘আরডি-৯৩এমএ’র।
যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনটিকে সামরিক ড্রোনে ব্যবহার করার সুবিধা হয়েছে। রুশ ফৌজ যে ‘মিগ স্ক্যাট’ মানববিহীন হামলাকারী উড়ুক্কু যান ব্যবহার করে, তাতে আছে ক্লিমভের তৈরি ‘আরডি-৯৩এমএ’। তবে ইঞ্জিনটির ‘ড্রাই’ সংস্করণ সেখানে লাগিয়েছেন মস্কোর প্রতিরক্ষা গবেষকেরা, যার শক্তি ৫০ কিলো নিউটনের সামান্য বেশি বলে জানা গিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনটি হাতে পেলে পাক সেনার শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে ‘আরডি-৩৩’ ইঞ্জিনটির উন্নত সংস্করণের কিছু সমস্যা রয়েছে। লড়াকু জেট ওড়ানোর জন্য বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারলেও কম সময়ের জন্য পরিষেবা দিয়ে থাকে ‘আরডি-৯৩এমএ’। এর জীবন মাত্র ২,২০০ ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায় বলে জানা গিয়েছে। সেখানে পুরনো ইঞ্জিনটির চার হাজারের বেশি ঘণ্টা ধরে কর্মক্ষম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, বর্তমানে ঘুরপথে এটি পাক সরকারের হাত তুলে দিচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে লড়াকু জেটের ইঞ্জিনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে চীন। তখনই ‘আরডি-৯৩’ ইঞ্জিনের ব্যাপারে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি হয় বেজিঙের। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। পরবর্তী কালে মনমোহন সিংহের আমলেও একই অবস্থান নিয়েছিল নয়াদিল্লি। যদিও তাতে কান দেয়নি মস্কো। একে সাধারণ বাণিজ্যিক চুক্তি হিসাবে বর্ণনা করে অন্য যুক্তি দেয় ক্রেমলিন। তাদের বক্তব্য, কোনো রকম প্রযুক্তি হস্তান্তর ছাড়াই লড়াকু জেটের ইঞ্জিন ড্রাগনকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, ২০০০ সালের গোড়া থেকে চীনকে ক্লিমভের কারখানায় তৈরি জেট ইঞ্জিন পাঠানো শুরু করে রাশিয়া। ফলে পরবর্তী দশকগুলিতে ঘরের মাটিতে একের পর এক যুদ্ধবিমান নির্মাণে বেজিঙের কোনো অসুবিধা হয়নি। বিশ্লেষকদের দাবি, ‘জেএফ-১৭’ যৌথ উদ্যোগে তৈরি লড়াকু জেট হওয়ায় সেখানে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে ড্রাগনের। ফলে ওই রাস্তায় মস্কোর ‘আরডি-৯৩এমএ’ হাতে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে ইসলামাবাদের।
এ ছাড়া গত ১৭ সেপ্টেম্বর পশ্চিম এশিয়ার ভারতের অন্যতম ‘মিত্র’ হিসাবে পরিচিত সৌদি আরবের সঙ্গে একটি ‘কৌশলগত এবং পারস্পরিক’ প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাকিস্তান। সেখানে বলা হয়েছে, তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা কোনো এক পক্ষ আক্রান্ত হলেই ইসলামাবাদ এবং রিয়াদ তাকে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে। সংশ্লিষ্ট সমঝোতার পর উপসাগরীয় আরব দেশটিকে ‘পরমাণু সুরক্ষা’র প্রতিশ্রুতির কথা বলতে শোনা গিয়েছে পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফের গলায়।
সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির পর পশ্চিম এশিয়ায় ‘মুসলিম দেশগুলোর ন্যাটো’ তৈরির দাবি তুলেছে পাকিস্তান। এর মাধ্যমে কাতার, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলির থেকে ভারতকে দূরে সরিয়ে ফেলার মরিয়া চেষ্টা রয়েছে ইসলামাবাদের। তবে এত কিছুর পরেও নয়াদিল্লির হাতে কোনো তাস নেই, তা ভাবলে ভুল হবে।
কূটনীতিকদের দাবি, আমেরিকা কখনওই কোনো নির্ভরযোগ্য সহযোগী নয়। অতীতে ‘অ্যামরাম’ সরবরাহের সময় ইসলামাবাদের উপর বিশেষ শর্ত চাপিয়েছিল ওয়াশিংটন। সেখানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে পাক বিমানবাহিনী শর্ত লঙ্ঘন করায় নানা ভাবে আর্থিক দিক থেকে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির উপর চাপ তৈরি করে মার্কিন প্রশাসন। এতে আরও বেশি বিপদের মধ্যে পড়ে পশ্চিমের প্রতিবেশী।
একই কথা সৌদি আরবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভারতের সঙ্গে রিয়াদের সুদৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। আর তাই পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেই নয়াদিল্লিকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দেয় উপসাগরীয় আরব দেশ। এর জন্য মোদি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে না বলে একরকম আশ্বাস দিয়েছে তারা।
এ ছাড়া ইসরায়েল, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মতো ‘বন্ধু’রা ভারতের হাত সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে, তা কিন্তু একেবারেই নয়। নয়াদিল্লির জন্য প্রথম দু’টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ তৈরি করতে পারে। তবে উত্তর দেবে সময়।
পালাবদল/এসএ