
ছবি: সংগৃহীত
দুই প্রতিবেশী ‘শত্রু’র সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলোচনা। তারপর যৌথ বিবৃতি প্রকাশ। হঠাৎ করেই তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটিকে কেন্দ্র করে চীন ও পাকিস্তানের সুরে সুর মেলাল ভারত। শুধু তা-ই নয়, এককাট্টা হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করেছে তারা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এ-হেন নজিরবিহীন দৃশ্যে হতবাক বিশ্ব। ফলে ‘কোথাকার জল কোথায় গড়ায়’ সে দিকে কড়া নজর রাখছেন দুনিয়ার দুঁদে কূটনীতিকেরা।
চলতি বছরের ৭ অক্টোবর সপ্তম সভা শেষে আফগানিস্তানকে নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেয় ‘মস্কো ফরম্যাট কনসালটেশন’। সেখানেই পাক-চীনের সঙ্গে একযোগে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে সুর চড়ায় নয়াদিল্লি। উল্লেখ্য, রুশ বিদেশ মন্ত্রকের প্রকাশ করা ওই যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “পাঠানভূমি এবং তার প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রে বিদেশি শক্তির সামরিক পরিকাঠামো তৈরি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য। এটা আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতার পরিপন্থী।”
পরে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন মস্কোয় কর্মরত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিনয় কুমার। তিনি জানিয়েছেন, স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল আফগানিস্তানের পাশে রয়েছে নয়াদিল্লি। পাঠানভূমির আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারতের পূর্ণ সমর্থন পাবেন সেখানকার তালেবান শাসক। এ বছরের ৯-১৬ অক্টোবর প্রথম বার দিল্লি সফর করছেন হিন্দুকুশের কোলের দেশটির ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। তিনি এ ভারতে আসার আগেই নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই পদক্ষেপকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৭ সালে আফগানিস্তানকে নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার জন্য রাশিয়ার উদ্যোগে তৈরি হয় ‘মস্কো ফরম্যাট’। নয়াদিল্লি ও কাবুলের পাশাপাশি এর সদস্যপদ রয়েছে চীন, পাকিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানের। এবারের বৈঠকে অবশ্য ক্রেমলিনের আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসাবে হাজির ছিল বেলারুশও। অতীতে এই গোষ্ঠীর আলোচনায় কখনওই বেজিং এবং ইসলামাবাদের সঙ্গে ১০০ শতাংশ সহমত পোষণ করতে দেখা যায়নি ভারতকে।
‘মস্কো ফরম্যাট’-এর এবারের বৈঠকে ছিল আরও একটি চমক। সেখানে আফগান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রথম বার একজন পূর্ণ সদস্য হিসাবে যোগ দেন তালেবানের ভারপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। ২০২১ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটি পাঠানভূমিতে ক্ষমতায় ফিরলেও তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমি দুনিয়া। অন্য দিকে কাবুলের তালেবান সরকারকে ইতিমধ্যেই মান্যতা দিয়েছে রাশিয়া এবং চীন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, আফগানিস্তান নিয়ে পাক-চীনের সুরে সুর মিলিয়ে নয়াদিল্লির যৌথ বিবৃতির নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে ভারতের লগ্নির অঙ্ক নেহাত কম নয়। দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছর ধরেই মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে মোদি সরকার। সেই রাস্তায় কাবুলের ‘বড় খেলোয়াড়’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সম্ভাবনা প্রবল, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
মধ্য এশিয়ার প্রায় প্রতিটা দেশের সঙ্গেই লম্বা সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের। পাঠানভূমিটি পুরোপুরি স্থলবেষ্টিত হওয়ায় সেখানকার তালেবান সরকারের পক্ষে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করা বেশ কঠিন। এ ব্যাপারে অবশ্য কাবুলের পাশে দাঁড়িয়েছে নয়াদিল্লি। বর্তমানে ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দক্ষিণ ইরানের চাবাহার বন্দর। আফগান প্রশাসনকে সেটি ব্যবহারের জন্য খোলাখুলি ভাবেই আহ্বান জানিয়েছে মোদি প্রশাসন।
তা ছাড়া আফগানিস্তানের মাটিতে ফের একবার মার্কিন ফৌজের পা পড়লে সেখানে সন্ত্রাসবাদের সূচক যে হু-হু করে ঊর্ধ্বমুখী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আঁচ জম্মু-কাশ্মির-সহ উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমের একাধিক রাজ্যের গায়ে লাগার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সেই কথা মাথায় রেখে এখন থেকে নয়াদিল্লি ঘুঁটি সাজাচ্ছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতির বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দিক থেকে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এর জন্য মার্কিন ফৌজকে রাস্তা দিতে হবে ইসলামাবাদকে। আর সেটা করে তালেবানের ‘চিরশত্রু’তে পরিণত হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই পাকিস্তানের। দ্বিতীয়ত, পাঠানভূমিতে মার্কিন ফৌজ গেলে রক্তচাপ বাড়বে চীনের। ফলে বেইজিংয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। সেটা কখনওই চায় না পাক সরকার।
অন্য দিকে গত চার বছরে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে বিপুল লগ্নি করেছে বেইজিং। সম্প্রতি কাবুলকে ‘চীন পাকিস্তান আর্থিক বারান্দা’ বা সিপিইসির (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) আওতাভুক্ত করেছে চীন। পাঠানভূমির বিরল খনিজ এবং অন্যান্য ধাতুর উপর প্রবল লোভ ড্রাগনের। তা ছাড়া বাগরামকে কেন্দ্র করে তাদের পরমাণু কর্মসূচির উপরে যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারি মেনে নেওয়া মান্দারিনভাষীদের পক্ষে অসম্ভব।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর বৃটেন সফরে গিয়ে হঠাৎ করেই আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন ট্রাম্প। ওই বিমানছাউনি ফেরত পেতে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আলোচনা চালাচ্ছে বলে স্পষ্ট করেন তিনি। এরপর নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এই নিয়ে একটি পোস্ট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে তিনি লেখেন, “বাগরাম বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে আমেরিকা। ওরা যদি সেটা ফিরিয়ে না দেয়, তা হলে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।”
ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারি অবশ্য গায়ে মাখেননি আফগানিস্তানের তালেবান নেতৃত্ব। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিষয়টিতে মুখ খোলেন কাবুলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ অফ স্টাফ ফসিহউদ্দিন ফিতরত। ‘মহাশক্তিধর’ আমেরিকাকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিতে শোনা যায় তাকে। ফসিহউদ্দিনের সাফ কথা, “কিছু লোক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাইছেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও বিদেশি শক্তির হাতে সমর্পণ করা হবে না। এখানে তাদের কোনো প্রয়োজন নেই।”
৯/১১ হামলার বদলা নিতে ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে আমেরিকা। মার্কিন সেনা অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এন্ডুরিং ফ্রিডম’। অতি অল্প দিনের মধ্যেই কাবুলের তখ্ত থেকে তালেবানকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। পরবর্তী ২০ বছর হিন্দুকুশের কোলের দেশটিকে নিজেদের দখলে রেখেছিল আমেরিকার বাহিনী। সেখানে তাদের যাবতীয় সৈনিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাগরাম সেনাঘাঁটি।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হলে আফগানিস্তানে বাড়তে থাকে কমিউনিস্ট প্রভাব। ওই সময় মস্কোর অর্থানুকূল্যে বাগরাম বিমানঘাঁটিকে সাজিয়ে তোলে তৎকালীন কাবুল সরকার। ১৯৭৯ সালে আমু দরিয়া পেরিয়ে কাবুল দখল করে সোভিয়েত ফৌজ। হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে ওই বিমানবাহিনীর ছাউনিকে আরও অত্যাধুনিক করে তোলে ক্রেমলিন।
১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ত্যাগ করে সোভিয়েত সেনা। পরবর্তী ১২ বছর বাগরাম বিমানঘাঁটির কোনো সংস্কার হয়নি। ২০০১ সালে মার্কিন সেনা হিন্দুকুশের কোলের দেশটি দখল করার পর ফের সেটিকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ওয়াশিংটন। সেই লক্ষ্যে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে পিছপা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। সেই খরচের বহর অবশ্য কত, তা আজও গোপন রেখেছে আমেরিকা।
উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের অন্তর্গত বাগরাম বিমানঘাঁটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় দেড় হাজার মিটার। রাজধানী কাবুল থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ৬০ কিলোমিটার। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ছাউনিতে রয়েছে দু’টি কংক্রিটের রানওয়ে। সেখানে অনায়াসেই অবতরণ করতে পারে ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ বা ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’-এর মতো ভারী ওজনের বিশাল বপু সামরিক মালবাহী বিমান। এ ছাড়াও ঘাঁটিটিতে রয়েছে লড়াকু জেট রাখার কমপক্ষে তিনটে বড় হ্যাঙ্গার। বিশ্লেষকদের দাবি, ওখান থেকে ড্রোন হামলাও পরিচালনা করতে পারবে বিশ্বের যেকোনো বাহিনী।
২০১৭-’২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন ট্রাম্প। ওই সময়ে কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে তার সরকার। সংশ্লিষ্ট সমঝোতার শর্ত মেনে ২০২০ সাল থেকে ধীরে ধীরে কাবুল ত্যাগ করতে থাকে মার্কিন বাহিনী। এই প্রক্রিয়া পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়েও অব্যাহত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ মে-র মধ্যে আমেরিকার সৈনিকদের হিন্দুকুশের কোলের দেশটি ছাড়ার কথা ছিল। যদিও গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে আগস্ট কেটে গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র সেনা সরাতেই আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরে তালেবান। এই ঘটনার চার বছরের মধ্যেই বাগরাম নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘আগ্রাসী’ মনোভাবে জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। সংশ্লিষ্ট বিমানঘাঁটিটির থেকে বেইজিংয়ের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির কেন্দ্রের দূরত্ব এক ঘণ্টারও কম বলে জানিয়েছেন তিনি। আর তাই ছাউনিটি ফেরত পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, ট্রাম্পের পক্ষে বাগরাম ফেরত পাওয়া মোটেই সহজ নয়। কারণ, স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হলে পাক ভূমিকে ব্যবহার করা ছাড়া আমেরিকার কাছে দ্বিতীয় রাস্তা নেই। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকে সেই করিডর দিয়েছিল ইসলামাবাদ। এবার কিন্তু সেই সুবিধা পাওয়ার আশা যথেষ্টই কম। কারণ, ‘মস্কো ফরম্যাট’-এর যৌথ বিবৃতিতে উল্টো কথা বলতে শোনা গিয়েছে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীকে।
পালাবদল/এসএ