![]()
ওকে রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে কি না - এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হয়েছে। রেখে যেতে না চাইলে এখানে অপেক্ষা করতে হয় - একটামাত্র দিক খোলা আছে অল্পক্ষণের মধ্যে পিছুহটার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে - সবাইকে আটকে পড়তে হবে। শুরুতে অনেকে দ্বিধান্বিত হলেও দ্রুতই সবাই একমত হলাম - ওকে এখানে রেখে যাওয়ার কথা আমরা ভাবতে পারছিলাম না। ততক্ষণে আমাদের পিছুহটাটাও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। পিছু হটতে হবে এমন চিন্তা নিয়ে আমরা এই অপারেশন শুরু করিনি। এই ব্যর্থতা আপাত এবং কঠিন শপথে উদ্দীপ্ত হওয়ার সুযোগ মাত্র। এ বিষয়ে আমাদের কারও কোন হতাশা নেই। একটা পীড়ন আছে - পীড়ন আমাদের শপথেরই অংশ। এখন ওকে রেখেই ফিরে চলেছি আমরা। এখান থেকে ফিরে যাওয়া মানে তো ফিরে যাওয়া নয় - জায়গাটাকে ওদের কব্জায় রেখে যাওয়া। আর এই রেখে যাওয়া মানেই যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসা এবং এই জায়গা ও পুরো এই দেশটাকে মুক্ত করা - তীব্র এই তাগিদ সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। খুব সতর্কতার সঙ্গে পিছু হটতে হচ্ছে। ধুক ধুক বাড়ার সাথে সাথে বুকের ভেতর ইস্পাতের মত এই প্রতিজ্ঞাও বহন করছি আমরা। এবার যতটা হতাশা তারচেয়ে অনেক বেশি আশা আমরা লালন করছি। গত অভিযানটায় আমাদের সাফল্য উত্তরের সব সেক্টরে আশা এবং শক্তি যুগিয়েছে - সেই উত্তাপ নিঃশেষ হয়নি বলেই মন ভেঙে পড়েনি। গত অভিযানে আগে বেড়েছি এবার পিছু হটেছি আগামীবার আগে বাড়ব - বাড়বই। আবার আসব আমরা - আমরা আসব এতে কোন সন্দেহ নেই। পাকিস্তানি হানাদারদের এখান থেকে হটিয়ে জায়গাটা মুক্ত করব। সামনে এগোবার পথ করতে হবে - এর কোন বিকল্প নেই - আবার আমাদের আসতেই হবে। এবার পুরো রেকি করা হবে। কৌশল নির্ধারণ-মোক্ষম আক্রমণ রচনা তখন আর কঠিন হবে না। ওর নাম কি মিন্টু - যাকে আমরা এখন অনেকটা বেখবর ফেলে রেখে যাচ্ছি - ওর নাম মিন্টুই হবে - মিন্টু একটা কমন নাম। পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় যাদের জন্ম তাদের বেশির ভাগের ডাকনাম মিন্টু-পিন্টু-নান্টু-সেন্টু আরও যত টু আছে - মিন্টু বলত, জানেন আনুভাই আমি যুদ্ধে আসতে চাইনি - বলতাম, তাহলে এলে কি করে? ও বলত, সেটাই তো কথা - বলতাম, সে কথাটাই বল না - মিন্টু ক্ষুব্ধ, ওরা - পাঞ্জাবিরা আমাদের যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে - ওরা কি ভেবেছে জানেন - বাঙালিরা ভীতু যুদ্ধ করতে যাবে না। বাংলার মানুষ যতই ভোট দিক এই ধাক্কায় অনেকদিন ওদের দাবিয়ে রাখা যাবে - শোষণ করা যাবে - একটু দম নিয়ে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে পঁয়ষট্টির যুদ্ধ - খেমকারান সেক্টর - আমার ছোট চাচা ক্যাপ্টেন আনিস - একটা বড় খেতাব পেয়েছেন - এপ্রিলে চাচার বদলি হয়ে ঢাকা আসার কথা ছিল - জানুয়ারিতে চাচীর ছেলে হয়েছে - ছবি পাঠিয়েছেন - মা তা দেখে বলেছেন দেখতে নাকি একদম আমার মত - আচ্ছা আনুভাই বাংলাদেশি আর্মি অফিসারদের কি হয়েছে - কি হতে পারে? বলতাম, অনেকে কাবুল হয়ে পালিয়ে আসছেন - কেউ ধরা পড়েছেন - মিন্টু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে, আমার চাচা ধরা পড়বেন না - ঠিক চলে আসবেন - চাচাকে আমি জানি। তবে চাচী আর বাবু - অত ছোট বাবু - মিন্টুর কপালে চিন্তার ছাপ - অনেকগুলো দৃশ্য একের পর এক তার চোখের উপর ছায়া ফেলত - ছায়াগুলো কাঁপত ভেঙেচুরে যেত - তারপর সব ঝেড়ে ফেলে বলত, যাই বলেন আমাদের চেতনায়-অভ্যস্ততায় এখন যুদ্ধ - আমরা যুদ্ধ করছি-করব-করতে থাকব - আরেকজন কেউ যোগ করত, যতক্ষণ না সবুজ এই দেশটা থেকে হানাদারদের হটাতে পারি - মিন্টু কথা না বলে চুপ মেরে যেত - নিস্তব্ধতা হয়ে ওঠত গভীরতর। অ্যাম্বুসে অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্বাস-প্রশ্বাসও স্বাভাবিক রাখা যেত না - কবরের মত নিঃস্তব্ধতা একে অন্যের মাঝখানে প্লাস্টার অব প্যারিস হয়ে আটকে থেকেছে। ও থেমে গিয়ে যে স্তব্ধতার জালে আমাদের আটকে দিত ওটা কাউকেই ভাবিত করত না। গত ক’মাসে যুদ্ধক্ষেত্রে বহু - বহু কথাই আমরা অসমাপ্ত রেখে অপেক্ষায় রয়েছি - সদর্পে অস্তিত্ব ঘোষণার এই অপেক্ষাও অবিশ্বাস্য তৃপ্তিতে ভরা। কে বলে অপেক্ষা মৃত্যুসম? অনেকক্ষণ পর কেউ একজন বলে ওঠত, ঠিক কথা - ওরা আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না - কিছুতেই না - আরেকজন বুকে বামদিকে কলজের উপর হাত রেখে বলত, ওদের কব্জার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা - এই আমরাই - মিন্টুর যুদ্ধে আসার গল্পটা আমরা একবারে শুনতে পাইনি ও অল্প অল্প করে বলেছে যেমন করে বললে গল্পটা শ্রোতাদের চেতনায় লেপটে থাকে - আসলে ওটা আমাদের সবার চেতনায়ই জ্বলছে। যেদিন ওর কিশোর ভাইটাকে ধরে নিয়ে যায় সেদিন ওর মা ওকে বাড়ি থেকে ঠেলে বের করে দেন। মা বলেন, শত্র“ পরিবেষ্টিত দশার কোন নিরাপত্তা নেই - শত্র“কে সামনে রেখে যুদ্ধ করা ছাড়া এরকম অবস্থায় কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই - নিরাপত্তা থাকে নারে মিন্টু - মিন্টু উদ্দীপ্ত, মা’র এ কথা যে কত সত্য এখন বুঝতে পারছি - প্রত্যেকটা অভিযানেই বুঝতে পারছি - জানেন আনুভাই মৃত্যুটা বড় নয় মোটেও - বড় হল শত্রু সামনে রেখে লড়তে পারছি - এর চেয়ে নিরাপদ আর কিছু নেই - কিছু থাকে না - যেদিন খবরটা পেল দিনভর দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। অদ্ভুত এক শব্দ বেরিয়েছে - নেকড়ের শব্দ আমি শুনিনি কিন্তু মনে হয়েছে এটা ক্ষিপ্ত নেকড়ের দাঁত ঘসটানির শব্দ। ওর মা-বাবার লাশ পাওয়া গেছে - লাশ পাওয়া যায়নি ছোট বোনের - কাউকে জীবন্ত লাশ বানান হলে তার পক্ষে কি লাশ হওয়া সম্ভব? দু’দিন পর থেকে আচমকা এরকম একটা প্রশ্নই মিন্টু করত। প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরে ঝিঁ-ঝিঁ শব্দে বাতাস কাঁপাত - বাতাস কাঁপতে থাকত - ও নিজে কাঁপত - আমরাও কাঁপতাম - আমরা ব্রহ্মপুত্রের চর পার হচ্ছিলাম সেই শুরুর দিকে। সামনে ধু ধু বালির চর - ডানদিকে কয়েকটা মাত্র ঝাউগাছ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও আর কিছু নেই - বাতাস শাঁ শাঁ করে বইতে থাকলে তার আঁচল দেখা যায়। কথাটা প্রথম মিন্টুই বলল। আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, আনুভাই আচমকা মনে হল সালমার শাড়ির আঁচলটা ঝিলিক মেরেছে - এই শাড়িটা পরলে মনে হত ও ঠিক মাটির একফুট উপরে পা ফেলে তরতরিয়ে হেঁটে চলেছে - অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম, কোথায়? সামনে মরীচিকা স্তব্ধতায় জমাট সাগরের মত কাঁপছে - আর কিছু নেই - কোথাও কিছু নেই। পায়ের তলায় তপ্ত বালি - মাথা সূর্যের আগুনে ঠেস দেয়া আর বুকে একটা দেশ - সবুজ-শ্যামল এই বাংলা নামের দেশটা জ্বলছে - শরীরে অসম্ভব জোর আসে - একটা অশরীরী শক্তি আলো-হাওয়ার আড়ালে আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ে। যেদিন এই প্রক্রিয়াটির উপর বোধের আলো ঝলসে ওঠল সেদিন রাতে ঘুমাতে পারলাম না কিছুতে। মিন্টুও অবাক, তাই ত এই মাত্র - মাত্র আধা সেকেন্ড - দেখলাম সবুজ জমিনে লাল ডোরাকাটা ঠিক সেই শাড়িটা - ওটা পরে ও যখন উড়ে উড়ে চলত - মনে হত ওর আর আমার মাঝখানে কেউ নেই - কিছু নেই। কেন মনে হত এখন বুঝতে পারি - তখন ওকে - থেমে যেত মিন্টু। তাকাদা লাগাতাম, তখন ওকে কি ? মিন্টুর চোখমুখে লাজুক আভা ছড়াত, দূর আনুভাই বুঝতে পারেন না কেন - বউ বউ লাগত - মিন্টু হঠাৎ আনমনা। মনের এরকম অবস্থায় মানুষ কথা নয় নীরব শ্রোতা চায় - মিন্টু শ্রোতা পায় - এরকম একেকটা গোপন-মোহন অধ্যায় অনেকেরই বুকের ভেতর চাপা পড়ে আছে। মিন্টুর বর্ণনার আয়নায় তারা তাদের ছায়াপাত দেখত। আচমকা মিন্টু নিজেই নীরব হয়ে পড়ত। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কথা আর ব্রহ্মপুত্র চরের এই বিরাণ-দশা - একটা আরেকটাকে দাবিয়ে রাখতে পারছে না। এই সংঘাত ঠেকাবার জন্য মিন্টুর থেমে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না। আসলে মিন্টুর গল্পটা কারও একার নয় সম্মিলিত গল্প - কমবেশি সবাই বাধ্য হয়ে যুদ্ধে এসেছি এবং সবারই প্রথম যৌবনের স্বপ্ন ও বাস্তবতা সময়ের তলায় চাপা দেয়া রয়েছে। এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না নিজে বাঁচার - মানুষ ও দেশ বাঁচাবার। সেই একই কথা - ওরা আমাদের ঠেলে দিয়েছে - আমরা অপ্রস্তুত ছিলাম কিন্তু জানবাজি একটি যুদ্ধে অসম্মত ছিলাম না - কারণ আমরা এটা বুঝতে পেরেছি যুদ্ধ ছাড়া আমাদের জীবন বাঁচে না - যুদ্ধ ছাড়া এখন আর আমাদের অস্তিত্ব নেই - থাকতে পারে না। এটা বোঝার জন্য আমরা অপেক্ষা করিনি - দরকার হয়নি। আমরা ফাঁকা দিকটা যথার্থই শনাক্ত করতে পেরেছি এবং দ্রুত পাকিস্তান আর্মির রেঞ্জের বাইরে এসেছি - এখন আস্ত একটা বিল মাঝ বরাবর পাড়ি দিচ্ছি। খোলা জায়গায় অন্ধকার তার গভীর ছাপ ফেলতে পারে না - আবছা আলোতে সব দেখা যায়। বিলটা বেঢপ আকারের - লম্বায় কম পাশে বেশি এবং একমাথা আবার বক্রাকার। এই পাশটা পাড় হবার পরই কেবল মনে করতে পারব আমরা নিরাপদ - তা-ও মনে করা মাত্র। কারণ এই জায়গাটা আমাদের কারও চেনা নয়। কাল তিনদিনের চাঁদ আকাশে মিলিয়ে যাবার পর এই পথেই আমরা এসেছি এটা এখন আর মনে হচ্ছে না। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে যে - আমাদের সেই গাইড লোকটা নাম ভুলে গেছি - সে এখন দীর্ঘদেহী জয়নালের কাঁধে চড়ে যাচ্ছে - তার পায়ে গুলি লেগেছে - ওকে কাঁধে তুলে নিয়েছে জয়নাল। এই জয়নাল লোকটা নাকি ছিল রমজান ডাকাতের সাগরেদ - কুড়ালের এক কোপে মানুষমারা রমজানের নাম সারা দেশে লোকে জানে। জয়নাল এখন সবচেয়ে জটিল-ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর দায়িত্ব নিজে কাঁধে তুলে নেয়। গত অভিযানের শুরুতে ইপিআর সিপাই হোসেন বললেন, আপনারা পেছনে চলে যান একদম আইলের ওপারে - আমি সিগন্যাল দেয়ার পরই আগে বাড়বেন। আর সিগনাল দিতে না পারলে আরও পিছু হটে অপেক্ষা করবেন তারপর অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন - আমরা তার কথা ঠিক ঠিক মেনেছিলাম। তার কথা না মেনে উপায় নেই - আমাদের সবার উস্তাদ। তার কাছেই থ্রি নট থ্রি’র ট্রিগার টেপা শিখেছি-গ্রেনেডের ক্লিপ খোলা-নিক্ষেপ করাটাও তার কাছেই শেখা। আমরা আটজন সবাই ছিলাম আনকোরা। মিন্টু তো গুলি ছুঁড়তে গিয়ে বারবার ধড়াস্ করে পেছনে পড়ে যাচ্ছিল - একমাত্র জয়নালই ঘণ্টা দেড়েকের চেষ্টায় রাইফেল কব্জা করে নেয়। আমরা ছাত্র যে ক’জন ছিলাম তারমধ্যে আমিই তৃতীয় দিনে রাইফেলটাকে হাতের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারলাম। সাতদিনের আগে কেউ রাইফেল বশে আনতে পারেনি। অপরিসীম ধৈর্য বেচারা হোসেনের। তার কথা - কয়দিন লাগল সেইটা বড় কথা না রাইফেলটা কব্জা করতে পারলেন কি না - এইটা আসল কথা। জানেন আমার উস্তাদ গফুর বালুচ কইতেন - রাইফেল হইল খানদানি অস্ত্র - এর কোন মিস নাই - লাগল তো খতম। ভারী অস্ত্রশস্ত্র নাই খালি রাইফেল হাতে যুদ্ধ করবেন এইটা কোন কমজোরির বিষয় না। আসল কথা হইল টার্গেট। হানাদার পাকবাহিনীগরে ঠিকমতো টার্গেট করবেন-ট্রিগার টিপবেন ব্যস্ খতম - আমাদের দুর্বলতাগুলো হোসেন তার কথা দিয়ে ভরে দিয়েছেন। আমাদের টার্গেট ঠিক আছে - এখন শুধু হিট করা। পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের মানুষ মনে করেনি - ওদের জন্ম হয়েছে রাজত্ব করার জন্য আর বাঙালিরা হবে ওদের প্রজা - এই জেদ নিয়ে ওরা যে কোন সীমা পর্যন্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাঙালিদের মনে হতাশা ছিল-ক্ষোভ ছিল-রাগ ছিল কিন্তু হিংসা ছিল না - যা ছিল পাঞ্জাবিদের অস্থি-মজ্জায়। আসলে এটা ছিল ওদের চক্রান্ত - চক্রান্তের চূড়ান্ত পর্ব শুরু করে ওরা ২৫ মার্চ রাতে। রাতের অন্ধকারে ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর। নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ মেরেছে। বিশ্বের একটা বড় আর্মি ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের সঙ্গে লড়াই করছে ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তান নামের বাঙালিদের এই দেশটা দখল করে নিয়েছে - নিজ দেশে বাঙালিরা এখন পরবাসী। আমরা যারা যুদ্ধে তারা আছি মোকাবিলার মধ্যে। কিন্তু যারা অবরদ্ধ দেশটায় আছে - তারা শ্বাসরুদ্ধ। পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম দখল করে নেয় - এরপর আগে বেড়ে উলিপুর তারপর চিলমারী পর্যন্ত পৌঁছে যায় - কুড়িগ্রাম থেকে আমাদেরও পিছুহটা শুরু। শেষ পর্যন্ত হোসেন বললেন - আর থাকা যাবে না এখানে। অস্ত্র দরকার - আরও লোক দরকার। ওরা এবার আমাদের হটিয়ে দিচ্ছে দিক - কিন্তু আমরা আবার আসব - চলেন - চিলমারী থেকে নদী পার হয়ে আমরা ব্রহ্মপুত্রের চরে পড়লাম - চর না মরুভূমি ঠাহর করতে পারলাম না - পারা সম্ভব নয় - ধূ ধূ করছে বালি - প্রচন্ড সূর্যতাপ এতটাই উত্তপ্ত করেছে যে বালি এখন বারুদ - যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরণে প্রস্তুত। বালি ভাঙতে ভাঙতে মনে হল - আমরাও প্রস্তুত - রবী ঠাকুর বলেছেন : জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য... হোসেন বললেন, বাচ্চালোক ঘাবড়াবেন না - মাত্র আট মাইল পার হলেই আমরা ঠাকুরচরে পৌঁছে যাব - ব্যস সেখান থেকে রৌমারি - তারপর মাত্র মাইল তিনেক বর্ডার - ওটা নিরাপদ জায়গা। পাকিস্তান-আর্মি পারতপক্ষে ওখানে কাউকে ঘাটাতে চায় না - হোসেন কথা শেষ করলেন না। তাকিয়ে দেখলাম ধু ধু বালির চরে ডানদিকে কয়েকটা মাত্র ঝাউগাছ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও আর কিছু নেই - বাতাস শাঁ শাঁ করে বইতে থাকলে তার আঁচল দেখা যায়। তখনই মিন্টু আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল সালমার শাড়ির আঁচল ঝিলিক মারার কথাটা। হোসেন পায়ের গতি থামিয়ে আমাদের কাছাকাছি এসে বললেন, আমরা অহন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমাদের অতীত নাই - বর্তমান বিপর্যস্ত - ভবিষ্যত আমাদের হাতে - মন স্থির রাখেন - হাতের আঙুলরে ট্রিগার বানান - ভবিষ্যত নির্মাণ করেন - স্বাধীন ভবিষ্যত - এসবই শুরুর দিককার বিষয়-আশয়। এখন কারও কোন শৈথিল্য নেই। জানবাজি - পাকিস্তানি সেনাদের দখলমুক্ত করব আমাদের সোনার বাংলাকে - জয়নালের কাঁধে লেপ্টে-থাকা লোকটা আহত হওয়ার সাথে সাথে বলল, আমার জন্য ভাববেন না আমি ছোটবেলায় অনেকবার এসেছি - এ গ্রামের প্রতি ইঞ্চি মাটি আমার পরিচিত আমি ঠিক চলে যেতে পারব। আপনারা দেরি করবেন না ওরা চারদিক ঘিরে ফেলছে - এখনই পিছু হটেন - প্রকৃতির ধরণ এবং ঘরবাড়ি কোন অবস্থায় এবং লোকজন আছে কি নেই এবং থাকলে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য - সে-ও আবার সবার কাছ থেকে নয় - সে লোকটা আমাদের কি না - এটাও বুঝতে পারার ব্যাপার আছে - এভাবেই আমাদের এগোতে হয় - এভাবেই আমরা এগিয়েছি বরাবর। এই অপারেশনেও এভাবেই আসতে হয়েছে - পুরো কোম্পানিতে এই এলাকার কোন মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায়নি। জয়নালের কাঁধের লোকটা নিজেই এক রাতে এসে হাজির। সে-ই বলল - আমি সব চিনি এই তল্লাটের। আপনাদের সাথে আমারে নেন - জয়নালকে পাঠান হল রেকি করতে - সে জোর করেই এই রেকি করার দায়িত্ব নেয় - নতুন আসা লোকটা যায় জয়নালের সাথে। লোকটা বলে আপনাদের কিচ্ছু ভাবতে হবে না - পাশের গাঁয়ে আমার মামার বাড়ি অনেকবার এসেছি। রাজাকারদের ক্যাম্পটা নতুন বাজারের পাশে আর পাকবাহিনীর ক্যাম্প ওখান থেকে শহরের দিকে এক মাইল পেছনে। পাড়া-ক্ষেতখলা-একটা মরাবিল - আমি জানি সব। জয়নাল ভাইরে সব দেখায়া দিমুনে। লোকটার আঘাত খুব মারাত্মক নয় - কোন ট্রেনিং না থাকায় মাটির সাথে মিশে যেতে পারেনি। মিন্টু বলেছিল, লোকটা রাজাকার না তো? আমার সন্দেহ হয় - শুরুর দিককার কথা। এরপর আর সন্দেহের কোন কারণ থাকেনি। লোকটাকে আমরা ফেলে আসিনি - ও বেঁচে যাবে। বিলটা পার হয়ে একটা ছোট গ্রাম তারপর বিশাল মাঠ-ব্রহ্মপুত্রের পাড় - ভোর হবার আগেই আমরা পৌঁছে যাব। লোকটা বাঁচবে - বাঁচাটা তার অধিকার - তবে রক্ত-ক্ষরা বাস্তবতা - মিন্টুকে ফেলে আসতে হয়েছে। ওকে নিয়ে আসার চেষ্টা - না - কোন সুযোগ পাইনি। ওকে আমাদের দৃষ্টির মধ্যে পাইনি - শ্রুতির মধ্যেও পাইনি। আমাদের সংকেত ধ্বনি দোয়েল পাখির ডাক। গোলাগুলি থেমে যাবার পর পাকিস্তান-আর্মি যখন সার্চলাইট ফেলছিল তখন দোয়েলের ডাকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। আমরা - অতগুলো প্রাণ একসাথে - বড় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমার। আসলে ও কোন সুযোগ রাখেনি। আমি ওকে নিষেধ করেছি ডানদিক দিয়ে আগে বাড়তে। মিন্টু কি বিজয় ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল? হয়ত তাই - মধ্যরাতে ওই বিলের মাঝখানে পৌঁছার পর মিন্টু আবছা আলোর মাঝখানে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, আনুভাই শেষ পর্যন্ত আপনিও আমাকে ফেলে চলে এলেন! আমি অবাক, মিন্টু তুমি! কোথায় ছিলে? মিন্টু হাসছে - ও যেমন করে হাসত, আনুভাই প্রাণটা বড় মূল্যবান মনে করিনি বলেই ওদের একদম ভেতরে ঢুকে গেছি - এটা এখন দরকার - খুবই দরকার - আমি মিন্টুকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম, মিন্টু তুমি খুব হটকারি কাজ করেছ - আর করবে না - একদম করবে না - এই যে আমরা বিল পার হচ্ছি আমাদের হৃদয় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে - তোমাকে দেখান যাবে - তুমি আমার বুকে বাঁদিকে হাত রাখ - কথা শেষ করার আগেই জয়নালের কাঁধ থেকে হঠাৎ লোকটা পড়ে গেল - শব্দটা সবাইকে দাঁড় করিয়ে দিল। করিম ওর মুখের কাছে কান পাতল - আমরা সবাই ওকে মাঝখানে রেখে গোল হয়ে কান পাতলাম - জয়নালও কান পেতেছে। সেই নিকষ অন্ধকারে আমরা লোকটাকে জড়িয়ে রাখতে চাইলাম। আমাদের সাথে যতগুলো গামছা ছিল সব ওর রক্তে টুপটুপা হয়ে গেছে - প্রায় দু’ঘন্টা ধরে ও একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে। আমি একবার বাঁদিকে আরেকবার ডানদিকে - একবার সামনে আরেকবার পেছনে তাকালাম। মিন্টু - মিন্টু কোথায়? এইমাত্র তো কথা বলল আমার সাথে। আমি কি ওদের এই কথাটা বলব - ওরা বিশ্বাস করবে? করতে পারে - এখনও বিশ্বাস করার সময় শেষ হয়ে যায়নি - মিন্টু বলত, জানেন আনু ভাই আমি একবারে মরতে চাই - ধুঁকে ধুঁকে মরব না - কখনও না - ও বলত, ওর বাবার কথা - ওর ভাইয়ের কথা। ও আরেকজনের কথা বলত। বলত, জানেন ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না - বাঁচবই না - ওর কথা ভাবতে ভাবতে কত রাত ভোর হয়ে গেছে - সেসব আরেক জনমের কথা - আকাশের ওপারে যে আকাশ আছে সেই আকাশে রঙধনুর কথা। এখন মনে হয় এই দেশ - দেশ ছাড়া আমি বাঁচব না - বাঁচবই না - আপনিই বলেন দেশ ছাড়া - মুক্ত স্বাধীন একটা দেশ ছাড়া মানুষ কি বাঁচে - বাঁচতে পারে? পারে না - পারেই না - ওর বোনের কথা - ওর মায়ের কথা - জিজ্ঞেস করতেই ও ক্ষেপে যেত, চোপ - চুপ করুন - ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতাম - ও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকত। চুপ করে তো বেশিক্ষণ থাকা যায় না - এক সময় অনেক দূর থেকে আসা ওর কণ্ঠ অবিরল কান্না হয়ে ওঠত - পাকিস্তানি-আর্মি বাবার সামনে ইজ্জত লুটে নিয়ে ওর মাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে - বাবাকে মেরেছে - বোনকে তুলে নিয়ে গেছে - আমরা যখন প্রাণহীন লোকটাকে তুলে নিয়ে বিল পার হলাম - আবছা গাছপালার সামনে তখন মিন্টুর কণ্ঠ - হুবহু সেই উদাত্ত কণ্ঠ অবিরল কান্নার মত ঝরে পড়তে লাগল - আমরা বাড়তি বিবেচনা ঝেড়ে শাণিত হয়ে ওঠলাম - তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হতে হয় - তারপর ঘুম। মিন্টুও কি এক সময় ঘুমিয়ে গেছে এই লোকটার মত - মিন্টুকে চেতনায় জড়িয়ে রাখতে রাখতে এক সময় আমি আর মনে করতে পারলাম না - ওর কী যেন নাম? আশ্চর্য! কেন মনে করতে পারছি না - ওর কী কোন নাম ছিল - তাও মনে করতে পারছি না কেন - আমার নামই বা কি? -এরা বলে টুআইসি। কমান্ডার হিসেবে এটাই ছিল আমার প্রথম অভিযান। এখনও টুআইসি-ই আমার নাম। এছাড়া আর কোন নাম আমার ছিল কী! সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে - মনে পড়ছে মিন্টুর নাম ছিল ‘এসএলআর’। প্রথম দু’টা মাত্র এসএলআর এসেছিল - তার একটা ওর জন্য বরাদ্দ করা হয় - এরপর সে হল এসএলআর। মিন্টু কি করেছিল! আমরা কেউ তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারিনি। এসএলআর পাওয়ার পর মিন্টু আরও দু’জনকে খতম করেছিল এবং আরও করত - বরাবর ও তাই করেছে। পুরো কোম্পানিতে এখন মাত্র চারটা এসএলআর তার একটা ওর - এটা ও অর্জন করেছিল। সবচেয়ে বেশি সাফল্য ছিল ওর। পুরনো থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে ও পাঁচজন পাঞ্জাবি খতম করে। তিনটা মাত্র অপারেশনে এই সাফল্য ছিল আমাদের মধ্যে অসাধারণ। আমাদের কোম্পানির প্রথম যে সুনাম নলডাঙ্গা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার ওটাও ওরই জন্য। এরপর একটা বিরাট এলাকা আমরা পেলাম - এই এলাকার মাঝখানে পাঞ্জাবিদের ঢোকে পড়ার কোন উপায় ছিল না - যোগাযোগের ক্ষেত্রে ওদের সামনে একটা বড় বাধা খাড়া হয়ে যায়। এরপরই কোম্পানিতে প্রথম আসা দুটা এসএলআর’এর একটা ও পেয়েছিল - ওরই পাওয়ার কথা - এসএলআর’এর গায়ে টোকা মেরে ও বলত, জানেন এটা আমার ডান হাত - এই ডান হাত আর চেতনা মিলে একটা প্রতিজ্ঞা - খতম। ওদের খতম না করা পর্যন্ত এই হাত থামবে না - থামবে না হাত - থামবেই না... ও বলত, রক্তে আগুনজ্বলাটা শুধু কথার কথা নয় - এর একটা বাস্তবতা আছে আর ওটা তখনই প্রকাশিত হয় যখন আমি একটা দখলদার সেনাকে খতম করতে পারি। কোন অভিযানে কোন খানসেনাকে খতম করতে না পারার অর্থ আমার অস্তিত্ব অর্থহীন - মানে আমি নাই - ওর কণ্ঠ ভাল ছিল ভরাট-উদাত্ত এবং রক্তে স্ফূলিঙ্গ-ছড়ান - গোটা কোম্পানি থাকত সতেজ-সটান। কমান্ডার ইঙ্গিত করা মাত্র ওর কণ্ঠ আগুন ছড়াত - উঠে বসত সবাই। মাঝেমাধ্যেই ওকে কণ্ঠ ছাড়তে হত। কেউ একজন প্রথম ওকে বলে, আমাদের ম্যাচবাক্স - জ্বালাও জ্বালাও - আগুন জ্বালাও তুমি - সবাই কণ্ঠ মিলাত। মিন্টু লাফিয়ে উঠত - উঠে দাঁড়াত - ওকে রেখে আমরা ফিরে যাচ্ছি - বিলের ঠান্ডা পানি রক্তে উত্তাল আকাক্সক্ষাকে স্পর্শ করতে পারেনি - টগবগ করে ফুটছে জ্বলন্ত স্বদেশ - ফুটছে আমাদের রক্ত - মিন্টু যখন ভরাট-উদাত্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ আবৃত্তি করত,‘... আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম - এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’ আমাদের রক্তে তখন বর্ষার উত্তাল তরঙ্গ গর্জে ওঠত - কামানের আগুনে গোলা-মর্টার শেল-জলপাইরঙ সাঁজোয়া গাড়ি সেই তরঙ্গস্রোতে চুরমার হয়ে যেত - আমরা উঠে দাঁড়াতাম - রাইফেলের বাট বুকে ঠেকিয়ে ট্রিগারে আঙুল রাখতাম - মিন্টু ছিল আমাদের আত্মার ট্রিগার - ওকে এরকম শত্রু পরিবেষ্টিত রেখে আমরা ফিরে যাচ্ছি - আবার আমরা আসব রক্তে আগুন জ্বালিয়ে - আমাদের রক্ত আর বারুদ এখন একই লক্ষ্যাভিমুখী - আবার পেছন থেকে সেই ডাক - আনুভাই দাঁড়ান - আমি চলে এসেছি - আমি আপনাদের দেখতে পাচ্ছি - দাঁড়ান - শেষরাতের আকাশে-বাতাসে মিন্টুর কণ্ঠ বারুদের মত বিস্ফোরিত হল - আমরা সেই বিস্ফোরণের মাঝখানে সটান হাতিয়ার ঊর্ধ্বে তুলে ধরলাম -
|