বিশ্বের অনেক দেশের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে৷ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরই) বলছে, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে যখন উদ্বেগ বাড়ছে, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মহাকাশ প্রযুক্তি প্রসারের ফলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা৷
বর্তমানে বিশ্বের নয়টি দেশের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে৷ এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দেশ পরমাণু কর্মসূচির আধুনিকায়ন চালিয়ে যাচ্ছে৷ এই আধুনিকায়নের মধ্যে রয়েছে, তাদের হাতে থাকা বর্তমান অস্ত্রগুলোর উন্নয়ন এবং এতে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা৷
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৫ সালে প্রকাশিত অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ ইয়ারবুক ২০২৫ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বব্যাপী নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড, বোমা এবং শেলের সংখ্যা ছিল ৬৪ হাজার৷ বর্তমানে এই সংখ্যা ১২ হাজার ২৪১৷ কমে আসার এই প্রবণতা এখন উল্টো দিকে ঘুরছে বলে প্রতিবেদনটিতে আশঙ্কা করা হয়৷
সংস্থাটির পরিচালক ড্যান স্মিথ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এই অস্ত্রের সংখ্যা কমিয়ে আনার পদক্ষেপের বিষয়টি আর থাকছে না৷”
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ
১৯৯১ সালে সোভিয়ত ইউনিয়নের পতন এবং শীতল যুদ্ধ অবসানের পর থেকে পরমাণু অস্ত্র কমিয়ে আনার হারের চেয়ে নতুন করে তৈরি করার হার বেড়েছে৷ এদিকে পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলোর মধ্যে এই অস্ত্রের আধুনিকায়নের বিষয়টি সাধারণ হলেও, স্মিথ মনে করেন, অ্যামেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের সময় থেকে এই প্রক্রিয়াটি তীব্রতর হয়েছে৷ তাছাড়া এই সময়ে নতুন প্রযুক্তির মিসাইল এবং বোমা বহনের খাতেও বিনিয়োগ বাড়ছে৷
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে পারমাণবিক বোমার সংখ্যা আনুমানিক ১২ হাজার ২৪১টি৷ এর মধ্যে নয় হাজার ৬১৪টি রয়েছে সামরিক বাহিনীর ভাণ্ডারে৷ এগুলো হয় কোনো মিসাইলে যুক্ত করা রয়েছে, অথবা সক্রিয় কোনো বেস স্টেশনে রয়েছে৷ কিংবা কেন্দ্রীয় গুদামে রয়েছে, যেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী মোতায়েন করা যেতে পারে৷
এদিকে আনুমানিক তিন হাজার ৯১২টি বোমা মিসাইল বা এয়ারক্রাফটে যুক্ত করা রয়েছে৷ প্রায় দুই হাজার একশ বোমা ব্যালাস্টিক মিসাইলে যুক্ত করা রয়েছে, যেন জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়৷ মিসাইলে বা এয়ারক্রাফটে যুক্ত থাকা বোমাগুলোর বেশিরভাগই রাশিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে৷ তবে আরেক পারমাণবিক শক্তিধর দেশ চীনও কিছু বোমা মিসাইলে যুক্ত করে রাখতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
পারমাণবিক শক্তিধর নয়টি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েল৷ বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ ভাগের মালিকানায় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া৷
গবেষকেরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশই এখন পারমাণবিক বোমা বানানোর কথা বিবেচনা করছে, কিংবা বিধ্বংসী এই অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখতে চাইছে৷ নিউক্লিয়ার শেয়ারিং চুক্তির মাধ্যমে এমনটা হতে পারে৷ উদাহরণ হিসেবে রাশিয়া-বেলারুশের কথা বলা যেতে পারে৷ ধারণা করা হচ্ছে, বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন করেছে রাশিয়া৷ তাছাড়া ইউরোপের অনেক দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা নিজেদের দেশে স্থাপন করে রাখার ইচ্ছা পোষণ করছে বলে জানা যায়৷
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকিতে
২০০৭ সালে জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত বিশ্বব্যবস্থার উপর নির্ভর না করার কথা জানান৷ সেইসাথে পূর্বদিকের দেশগুলোতে ন্যাটোর বিস্তৃতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন পুতিন৷
এমন হুমকি সত্ত্বেও ২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের কথা বলেন৷ চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ শহরে দেওয়া এক বক্তৃতায় ওবামা বলেন, “স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে আসা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস হলো পারমাণবিক অস্ত্র৷” এমন উক্তি অবশ্য সেসময় তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে সহায়তা করে৷
তিনি বলেন, “পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে শক্তিশালী পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সাথে একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক রিডাকশন ট্রিটি’ নামে চুক্তি করা হবে৷” অবশ্য স্বাক্ষরের পর চুক্তিটি ২০১১ সালে কার্যকর হয়৷
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বাইডেন প্রাশাসনের প্রকাশিত নিউক্লিয়ার রিভিউতে দেখা যায়, পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকীকরণের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে পুতিন ওবামার সময়ে করা চুক্তি থেকে সরে আসতে একটি আইন পাশ করে৷
গবেষক স্মিথের মতে, ২০০৭-২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে নিরাপত্তাহীণতার জোয়ার গড়ে উঠতে থাকে এবং ২০২২ সালে তা আছড়ে পড়ে৷
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, চীনের কাছে বর্তমানে অন্তত ছয়শ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে এবং অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় চীন দ্রুত গতিতে তার পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার প্রসারিত করছে৷
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির অনুমান, ভারতও ২০২৪ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার কিছুটা সমৃদ্ধ করেছে৷ একই কাজ করছে পাকিস্তানও৷ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জড়ো করছে দেশটি৷
ইসরায়েল অবশ্য নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে কখনোই স্পষ্ট তথ্য দেয়নি৷ তবে পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার আধুনিকায়ন করছে দেশটি- এমন সন্দেহ গবেষকদের৷
ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মহাকাশ প্রযুক্তি
ইয়ারবুক ২০২৫-এর সূচনায় গবেষক স্মিথ নতুন পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “এতে শীতল যুদ্ধের সময়ের চেয়েও আরো বেশি ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা রয়েছে৷” এর কারণ হিসেবে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, সাইবার সক্ষমতা এবং মহাকাশ প্রযুক্তির কথা বলেন৷
কার কত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে সে বিষয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারি করা হবে সেই প্রশ্ন উঠেছে৷
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন কিলার রোবটের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে৷ কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে স্বয়ংক্রিয় এবং আধা স্বয়ংক্রিয় ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ কিন্তু এই প্রযুক্তির সাথে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পর্কের বিষযে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না৷
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তথ্য যাচাই-বাছাই করা যায়, যার ফলে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ খুব দ্রুত নেওয়া যায়৷ কিন্তু এমন সফটওয়্যারে বা সিস্টেমে যেটি মেশিন লার্নিং, কিংবা এআই-এর সাথে জড়িত, সেখানে ছোট্ট ভুলেরও ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে৷
স্মিথ বলেন, “আমার মনে হয়, একটি সীমারেখা থাকা উচিত৷ এটি এমন হতে পারে যে, সব রাজনৈতিক নেতা, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা একমত হবেন যে, পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নেয়া হবে না৷”
এই বিষয়ে তিনি রাশিয়ার লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টানিসলাভ পেত্রোভের উদাহরণ তুলে ধরেন৷
১৯৮৩ সালে মস্কো থেকে ৬২ মাইল দক্ষিণে রাশিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের দায়িত্বে ছিলেন৷ সেসময় সিস্টেম থেকে জানানো হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইল ছোঁড়া হয়েছে৷ জবাবে ওয়ার্নিং সিস্টেমের তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে পেত্রোভ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন৷ এর ফলে ভয়ানক যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল৷
তবে গবেষক স্মিথ বলছেন, “আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেত্রোভের দায়িত্ব কে পালন করবে?”