শনিবার ৪ অক্টোবর ২০২৫ ১৯ আশ্বিন ১৪৩২
শনিবার ৪ অক্টোবর ২০২৫
 
বিদেশ
কাতারকে যেকোনো মূল্যে রক্ষার আদেশ ট্রাম্পের, কী প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে?





বিবিসি
Friday, 3 October, 2025
8:16 PM
 @palabadalnet

কাতারের আমিরের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

কাতারের আমিরের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সপ্তাহে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে তিনি পারস্য উপসাগরীয় দেশ কাতারকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করাসহ সব পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন ক্ষুদ্র জ্বালানি-সমৃদ্ধ এই দেশটির ওপর যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র কাতার রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রয়োজনে সামরিকসহ সব আইনানুগ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই আদেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার একটি গুরুত্বপূর্ণ আরব মিত্রের মধ্যে একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা চুক্তির অংশ, যা প্রায় ন্যাটো জোটের বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রতিফলিত করে।

ধারণা করা হচ্ছে, এটি তার আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হবে।

উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হলো, কাতার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তার প্রতিবেশীদের দ্বারা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বয়কটের কেন্দ্রবিন্দু থেকে এখন মধ্যপ্রাচ্যের দূতের ভূমিকায় চলে এসেছে। তারা সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে।

হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত এবং গত সোমবার হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ২০-দফা গাজা শান্তি প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে হামাস।

দোহায় এই অঞ্চলের বৃহত্তম মার্কিন বিমান ঘাঁটি আল উদেইদও অবস্থিত।

কাতারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার ট্রাম্পের পদক্ষেপ গত মাসে ক্ষমতাসীন আল থানি পরিবারের ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়। ওই সময় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো ইসরায়েলি বিমান হামলায় কাতারের নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন।

এই বছরের শুরুতে ইরানও কাতারে হামলা চালিয়েছিল। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় মার্কিন হামলার প্রতিশোধ হিসেবে হামলাটি করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্বের কারণে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মূলে রয়েছে কাতার। এছাড়া মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করতে দেওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে যথাযথ নিরাপত্তা সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

তবে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানিয়ে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এটি “দুই দেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব জোরদার করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”

কিন্তু ট্রাম্পের পদক্ষেপের সময়কাল এবং উদ্দেশ্য নিয়ে গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসছে, যার কারণে ওয়াশিংটন একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। এটি ভঙ্গুর ও উত্তাল একটি আঞ্চলিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে এমন এক পদক্ষেপ। বিশেষ করে যখন গাজার ভবিষ্যতের জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে হামাস।

ইসরায়েলে নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান শাপিরো মনে করছেন, মূলত কাতারের দেওয়া আশ্বাসের কারণে ট্রাম্প তাদের পুরস্কৃত করছে। “কাতারের প্রতি ট্রাম্পের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির কোনো অর্থ হয় না, যদি না তারা হামাসের কাছ থেকে হ্যাঁ উত্তর এনে না দেয়। অথবা ‘না’-বাচক উত্তরের জন্য যদি তাদের বহিষ্কার না করে,” শাপিরো বলেন।

ইসরায়েল বিষয়টিকে কীভাবে দেখতে পারে তার একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ। পত্রিকাটিতে লেখা হয়েছে, “ট্রাম্প কাতারে থাকা হামাসের নেতৃত্বকে দায়মুক্তি দিয়েছেন, যদিও নেতানিয়াহু সতর্ক করেছিলেন যে হামাস যেখানেই যাক না কেন তারা নিরাপদ থাকবে না।”

কিন্তু উপসাগরীয় বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ট্রাম্পের গ্যারান্টি একটি অস্থির অঞ্চলকে নাড়া দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা ইসরায়েলের সীমানার বাইরে ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রয়োগ এবং উপসাগরে মার্কিন নিরাপত্তার ছত্রছায়ার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ফোরাম ইউরেশিয়া গ্রুপের ফিরাস মাকসাদ বলেছেন যে, ট্রাম্পের পদক্ষেপ কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য উপসাগরীয় মিত্রদের আশ্বস্ত করার আরেকটি পদক্ষেপ।

তিনি আরও বলেন, তিনি আশা করেছিলেন সৌদি আরবও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি চাইবে।

“আমি মনে করি তাদের পাশে রাখা মার্কিন স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” মাকসাদ বিবিসিকে বলেন।

কাতারের জন্য নিরাপত্তা গ্যারান্টির পরিধি বেশ বিস্তৃত। কেউ দেশটিতে আক্রমণ চালালে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা এই চুক্তির আওতায় পড়ে।

এটি ন্যাটোর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের কথা মনে করিয়ে দেয়, জোটের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ হলে যৌথ প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে।

কিন্তু হোয়াইট হাউস থেকে একটি নির্বাহী আদেশ হিসেবে জারি হওয়ায়, কাতারকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়টি কংগ্রেসকে এড়িয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্টের আওতায় মার্কিন বাহিনীকে এ ধরনের দায়িত্বে নিয়োজিত করার আগে প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসে জানাতে হবে বিষয়টি।

এর মানে হলো, আদেশটির আইনগত শক্তির অভাব থাকতে পারে এবং ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টের অধীনে এটি পুনর্লিখন বা বাতিল করা যেতে পারে। কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকেও এটি তদন্তের মুখোমুখি হতে পারে।

ট্রাম্পের নিজস্ব ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ বা মাগা ক্যাম্পেইনের সমর্থকদের একটি অংশও এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, যারা এটিকে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডার সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করবে।

ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ একজন প্রভাবশালী অতি-ডানপন্থি কর্মী লরা লুমার বলছেন, কাতার আমেরিকার জন্য মিত্রের চেয়েও হুমকি হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি। 

ট্রাম্প-অনুগত রেডিও হোস্ট মার্ক লেভিন বলেছেন, এই আদেশটি এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত জোটকে ভেঙে দিয়েছে। “যদি কাতারে হামাসের কোনো নেতা ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়, তাহলে আমরা কি ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি?” প্রশ্ন করেন তিনি।

এছাড়া কাতারের সাথে ট্রাম্প পরিবারের ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক সংযোগের বিষয়টিও রয়েছে, যেটিকে তার বিরোধিরা অতি-ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্রটির সঙ্গে তার বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলে মনে করে।

ট্রাম্প অর্গানাইজেশন, যা তার ছেলে এরিক এবং ডোনাল্ড জুনিয়র দ্বারা পরিচালিত, এপ্রিল মাসে কাতারে একটি বিলাশবহুল গলফ রিসোর্ট তৈরির চুক্তি করেছে। সৈকত লাগোয়া রিসোর্টও থাকবে সেখানে। কাতারের সরকারি মালিকানার একটি ফার্মের সঙ্গে এই চুক্তি হয়েছে।

কাতার যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ৭৪৭ জেটলাইনারও দিয়েছে, যা ট্রাম্প এয়ার ফোর্স ওয়ানের পরিবর্তে ব্যবহার করতে চান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে, তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর এটি বাতিল করা হবে এবং তার নির্মাণাধীন প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরিতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।

হোয়াইট হাউস এবং কাতারি কর্মকর্তারা ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং নীতি নিয়ে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয় অস্বীকার করেছেন। তবে এই দুটি বিষয়ে সীমানা ট্রাম্প মুছে ফেলছেন বলে অভিযোগ করেছেন ওয়াচডগ গ্রুপ অ্যাকাউন্টেবল ডট ইউএসের টনি কার্ক।

“ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টতই চান যে মার্কিন করদাতারা তার বিলাসবহুল কাতার গলফ কোর্সের সম্ভাব্য সামরিক সুরক্ষার জন্য বিল বহন করুক এবং তার কাতারি সরকার সম্পর্কিত ব্যবসায়িক অংশীদারদের অনুগ্রহ লাভ করুক,” তিনি বলেন।

ট্রাম্প মে মাসে তার আঞ্চলিক সফরের অংশ হিসেবে দোহা সফর করেছিলেন, যেখানে এই অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং ধনী ব্যক্তিদের সাথে বাণিজ্য আলোচনা জড়িত ছিল। কিন্তু হোয়াইট হাউস সর্বদা স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আনা কেলি বিবিসিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্পদ তার সন্তানদের দ্বারা পরিচালিত একটি ট্রাস্টে রয়েছে। এখানে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই।”

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com