ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে গাজা অভিমুখে নতুন করে আরও ১১টি জাহাজ যাত্রা করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) জানিয়েছে, এসব নৌকায় প্রায় ১০০ জন অধিকারকর্মী আছেন।
১৫ বছরের সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞতা আছে এফএফসির। এর আগে এফএফসি মাদলিন ও হান্দালা ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিল। এবার অবরোধ ভাঙতে এফএফসি ব্যবহারিক পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও প্রক্রিয়াগত সহায়তা দিচ্ছে।
এক বিবৃতিতে এফএফসি জানিয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বর ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজ আরও ৮টি নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে ইতালি ও ফ্রান্সের পতাকাবাহী নৌবহর ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’ যোগ দিয়েছ। এই বহরে রয়েছে দুটি নৌকা। একসঙ্গে এ দুটি দল ১১টি জাহাজের বহর নিয়ে গাজা অভিমুখে ছুটে চলছে।
বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এই বহরে থাকা ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে আছেন। এসব নৌযানের লাইভ ট্র্যাকিং এই লিংকে দেখা যাচ্ছে।
আজ শুক্রবার দুপুরে ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় শহিদুল আলম বলেছেন, তাদেরটা সবচেয়ে বড় জাহাজ। তাদের সঙ্গে আরও আটটি ছোট নৌকা আছে। আজ তারা ফিলিস্তিনি টাইম জোনে পৌঁছেছেন। তবে এখনো দূরত্ব আছে।
কোয়ালিশনের তথ্য অনুযায়ী, নৌযানগুলো বর্তমানে ক্রিট দ্বীপের (পূর্ব ভূমধ্যসাগর) উপকূলে অবস্থান করছে এবং এতে প্রায় ১০০ যাত্রী আছেন।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো ও সেখানে চলমান অবরোধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার মিশন চালিয়েছে।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে ২৫টি দেশের সাংবাদিক ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। এফএফসির সর্বশেষ এই মিশন গত বুধবার যাত্রা শুরু করে। ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গাজা অভিমুখে রওনা হয়েছে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও চিকিৎসকবাহী এই জাহাজ।
প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে। এ সময়ে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, অনেকে আটক ও কারাগারে বন্দী আছেন।
একই সঙ্গে ধারাবাহিক অবরোধ ও বোমাবর্ষণে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসক দলগুলোকেও গাজায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। যাঁরা অনুমতি পান, তাদেরও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বা সরঞ্জাম আনার অনুমতি দেওয়া হয় না।
জাহাজে থাকা এফএফসির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হুয়াইদা আরাফ বলেন, “‘কনসায়েন্স’ শুধু ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক নয়, বরং বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার ডাক।”
ইতালির চিকিৎসক রিকার্ডো কোররাদিনি বলেন, “সাংবাদিক ও চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সত্য বলা ও জীবন রক্ষা করা। এই মিশন আমাদের সহকর্মীদের প্রতি এক আহ্বান-আর সেই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও, যাতে তারা নীরবতা ভাঙে, নীতিনৈতিকতা বজায় রাখে এবং ইতিহাসের পাশে দাঁড়ায়।”
এদিকে ত্রাণ নিয়ে গাজা অভিমুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের সবশেষ জাহাজটিও আজ শুক্রবার আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা উপকূলে আসলে ম্যারিনেট নামের জাহাজটির দখল নেন ইসরায়েলি সৈন্যরা। এর আগে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের অন্য সব জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। এসব নৌযানে থাকা অধিকারকর্মীদের আটক করা হয়।
এর আগেও ইসরায়েল গাজাগামী নৌযানে হামলা চালিয়েছে, জাহাজের মালামাল বাজেয়াপ্ত করেছে এবং অধিকারকর্মীদের বহিষ্কার করেছে।
ইসরায়েল প্রায় ১৮ বছর ধরে গাজায় অবরোধ চালিয়ে আসছে। প্রায় ২৪ লাখ মানুষের বাস এই উপত্যকায়। চলতি বছরের মার্চে সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে অবরোধ আরও কড়াকড়ি করা হয়। এতে ভূখণ্ডটি চরম খাদ্যসংকটে পড়ে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার সতর্ক করছে, এই অবরুদ্ধ অঞ্চলে অনাহার ও রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, আর গাজা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার ২০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের অভিযানে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন ছাড়াও আরও তিনটি জোট অংশ নিয়েছে। তারা আগে গাজায় স্থল ও সমুদ্রপথে একই প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিল। এই জোটগুলো হলো:
গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা (জিএমটিজি): এটি আগে গ্লোবাল মার্চ টু গাজা নামে পরিচিত ছিল। এটি একটি তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন। এরা গাজার প্রতি বিশ্ব সংহতির কর্মসূচি আয়োজন করে এবং অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করে।
মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা: এটি আগে ‘সুমুদ কনভয়’ নামে পরিচিত ছিল। এটি উত্তর আফ্রিকাভিত্তিক একটি উদ্যোগ, যা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ত্রাণ ও সহায়তা পৌঁছে দিতে সংহতির মিশন পরিচালনা করে।
সুমুদ নুসান্তারা: এটি মালয়েশিয়াসহ আরও আটটি দেশের জনগণের নেতৃত্বাধীন বহর, যা গাজার অবরোধ ভাঙতে এবং গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর মধ্যে সংহতি জোরদার করতে চায়।