অতিভারি বর্ষণে ভারতের উত্তর সিকিমের জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। এ ছাড়া বন্যায় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ। এর প্রভাবে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ছে তিস্তায়। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেও দেখা দিতে পারে বন্যা। তিস্তা অববাহিকার লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরে বন্যার পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
অন্যদিকে হিমালয়ার ছোট এই রাজ্যে আটকেপড়া পর্যটকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে আনার কথা ভাবছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। খবর রয়টার্সের।
এখনো ১৬ সেনাসহ ১০৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা নদীর নিম্নপ্রবাহে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত পানির তোড়ে ভেসে আসা ১৮টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি মৃতদের মরদেহ আজ উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশের রংপুর ও লালমনিরহাটে তিস্তা নদী থেকে ভারতীয়র ৩ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বন্যার পানিতে এই মৃতদেহ ভেসে আসে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
মঙ্গলবার রাতভর ভারি বৃষ্টির পর বুধবার ভোরে পর্বত থেকে নেমে আসা পানির প্রবল চাপে সিকিমের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সিকিম উর্জার চুংথাং বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যায়। তাতে তিস্তা নদীর নিম্ন প্রবাহের অনেক এলাকা হড়কা বানে ভেসে যায়।
ভারতের জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, সিকিমের ধ্বংসলীলার প্রাথমিক কারণ অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং ১৭০৬০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লোনক হ্রদের পানি পাড় ভেঙে নেমে আসা।
বৃহস্পতিবার ভারতের মহাকাশ সংস্থার প্রকাশ করা স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, পাড় ভেঙে পানি নেমে আসার পর লোনক হ্রদের আকার অনেক ছোট হয়ে গেছে।
ভারতের ন্যাশনাল রিমোট সেনসিং সেন্টার এর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট ছবিগুলোতে দেখা গেছে হ্রাদের আকার বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৬২ দশমিক ৭ হেক্টরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু পাড় ভেঙে বিপুল পরিমাণ পানি নেমে যাওয়ার পর হ্রদের আকার ছোট হয়ে ৬০ দশমিক ৩ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এনডিটিভি জানিয়েছেন, উঁচু থেকে নেমে আসা ঢলের তোড়ে ১৪টি সেতু ধসে গেছে এবং রাজ্যের বিভিন্ন অংশে তিন হাজারের বেশি পর্যটক আটকা পড়েছেন। স্থানীয় ২৫০০ বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং প্রায় ৬০০০ জন ত্রাণশিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন।
সিকিম রাজ্য সরকার আরেকটি হিমবাহ হ্রদে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে। আগের হড়কা বানে সেনাশিবির থেকে বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ ভেসে যাওয়ায় সে বিষয়েও সতর্কতা জারি করেছে তারা। লাচেনের নিকটবর্তী শাকো চো হ্রদও পাড় উপচে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কর্তৃপক্ষ ওই হ্রদের আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে।
সিকিমের মুখ্য সচিব বিজয় ভূষণ পাঠক বলেছেন, “লাচেন ও লাচুংয়ে প্রায় ৩০০০ মানুষ আটকা পড়ে আছেন। মোটরসাইকেল যোগে সেখানে গিয়েছিলেন আরও ৩১৫০ জন, বন্যার কারণে তারাও আটকা পড়েছেন। আমরা সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার দিয়ে তাদের সরিয়ে আনবো।”
হড়কা বানে মঙ্গন জেলায় আটটি, নামচিতে দু’টি ও গ্যাংটকে একটি সেতু পানির তোড়ে ভেসে গেছে। আরও বহু সেতু পানিতে ডুবে আছে। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর পানি সরবরাহের পাইপলাইন, পয়নিষ্কাশন লাইন, বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিস্তা পাড়ের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত পাকিয়ং, গ্যাংটক, নামচি ও মঙ্গন জেলার ২৭৭টি বাড়ি ধ্বংস বা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু বাড়ি ও গাড়ি কাদারস্রোতের নিচে তলিয়ে আছে, অনেক গাড়ি ভেসে গেছে।
মঙ্গন জেলায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে ও ১৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন, গ্যাংটকে মারা গেছেন পাঁচজন আর নিখোঁজ রয়েছেন ২২ জন। পাকিয়ংয়ে ছয় সেনাসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৫৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
লোনক হ্রদে বিপর্যয় আসবে! সতর্ক করেছিল ইসরো
মঙ্গলবার লোনক হ্রদ ফেটে সিকিমে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছে ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ (জিএলওএফ)। তবে সিকিমের বুকে যে দুর্যোগ নেমে আসতে পারে, তা নিয়ে অতীতে বহু বার সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। গত এক দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং গবেষকরা সিকিমে হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদ ফেটে মারাত্মক বন্যা নিয়ে সতর্কতা জারি করেছেন। সাবধান করেছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোও।
জিএলওএফ হয় তখনই, যখন হিমবাহ গলা জল জমে সৃষ্ট হ্রদগুলি অতিরিক্ত পানি জমার কারণে বা ভূমিকম্পের মতো কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফেটে যায়। গবেষণায় আগেই প্রকাশ্যে এসেছিল যে, সিকিমের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দক্ষিণ লোনক হ্রদ ১৪টি বিপজ্জনক হ্রদের মধ্যে একটি, যেখানে জিএলওএফ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১২-’১৩ সালে ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার এবং ইসরোর একটি সমীক্ষায় লোনক হ্রদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ঝুঁকি তুলে ধরা হয়েছিল। হ্রদ ফেটে বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা ৪২ শতাংশ বলেও ওই সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল।
২০২১ সালেও উত্তর সিকিমের লোনক হ্রদ নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। তখন যদিও বিষয়টি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো হয়নি। তবে শেষরক্ষা হলো না। বুধবার লোনক হ্রদ ফেটে সৃষ্ট হড়পা বানে সিকিমের ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে।
এ ছাড়াও ২০১৬ সালে, লাদাখের ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্টের’ সোনম ওয়াংচুক, জিএলওএফ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। জিএলওএফ রোধ করার জন্য হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদে উচ্চ ঘনত্বের পলিথিন পাইপ বসানো হয়েছিল।
২০২১ সালের একটি গবেষণাপত্রেও দক্ষিণ লোনক হ্রদকে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘‘লোনক হিমবাহ ১৯৬২ থেকে ৪৬ বছরে প্রায় ২ কিমি পিছিয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আরও ৪০০ মিটার পিছিয়ে গিয়েছে। ফলে লোনক হ্রদে বিপদের সম্ভাবনা বেড়েছে। হ্রদ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর মানুষ বাস করেন। ফলে তাঁদেরও বিপদ থেকে যাচ্ছে।’’
২০০১ সালের ‘সিকিম হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে’ও হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদ ফেটে সিকিমে বিপত্তি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছিল।