রবিবার ১২ অক্টোবর ২০২৫ ২৭ আশ্বিন ১৪৩২
রবিবার ১২ অক্টোবর ২০২৫
 
বিদেশ
মসজিদের বদলে স্কুল-হাসপাতাল চাইলেন বুরকিনা ফাসোর ইব্রাহিম





পালাবদল ডেস্ক
Saturday, 11 October, 2025
11:34 AM
 @palabadalnet

 বুরকিনা ফাসোর  শাসক ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে। ছবি: সংগৃহীত

বুরকিনা ফাসোর শাসক ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে। ছবি: সংগৃহীত

গায়ের রং চাপা। পেটানো চেহারা। উচ্চতা ছ’ফুটেরও একটু বেশি। পরনে সব সময় থাকে কমলা রঙের জংলাছাপ পোশাক। মাথায় টকটকে লাল রঙের টুপি। বয়স মাত্র ৩৭। এই বয়সেই আফ্রিকা কাঁপাচ্ছেন বুরকিনা ফাসোর  শাসক ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে।

নিজের দেশে বুরকিনা ফাসো তো বটেই, আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও ঈর্ষনীয় ভাবে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে ‘ক্যারিশম্যাটিক’ নেতা ইব্রাহিমের। এমনকি, তার দিকে নজর রাখছে আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্সের মতো তাবড় দেশও।

কয়েক দশক ধরে বুরকিনা ফাসো ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। ১৯৬০ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও প্রকৃত স্বাধীনতা অধরাই থেকে যায় সে দেশের বাসিন্দাদের জন্য। আনুষ্ঠানিক ভাবে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হলেও ফ্রান্সের প্রভাব তার পরেও কমেনি সে দেশে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পল-হেনরি সান্দাওগো দামিবা পরিচিত ছিলেন ‘বাধ্য’ নেতা হিসাবে। দেশের মানুষ চরম দারিদ্র এবং সঙ্কটের মুখে থাকলেও নাকি ফ্রান্সবিরোধী কোনো পদক্ষেপ করেননি তিনি।

এমনকি, বুরকিনা ফাসো পশ্চিম আফ্রিকার ‘সিএফএ ফ্রাঁ’ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিল, যা ফরাসি কোষাগার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ছিল। ফরাসি ব্যাঙ্কগুলিতে বুরকিনা ফাসোর বিদেশি মুদ্রাভান্ডারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ থাকায় দেশের আর্থিক সম্পদ ফ্রান্সে পাচার করা হচ্ছিল বলে অভিযোগও উঠেছিল।

বুরকিনা ফাসোর ইউরেনিয়াম এবং সোনার খনিগুলির দখলও বহু দিন ছিল বিদেশি সংস্থাগুলির হাতে। খনন থেকে রফতানি-সবই নিজেদের হাতে রেখেছিল সংস্থাগুলি। ফলে সে দেশের মানুষের কোনো লাভ হয়নি। মনে করা হয়, দীর্ঘ দিন ধরে পরিকাঠামো থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিলেন বুরকিনা ফাসোর সাধারণ মানুষ। অভিযোগ উঠেছিল, বুরকিনা ফাসোর মানুষের জীবনযাপন উন্নত করার ক্ষেত্রে খুব কম আগ্রহ ছিল দামিবার। বরং তার আগ্রহ বেশি ছিল ফরাসি স্বার্থকে জিইয়ে রেখে নিজের পকেট ভরানোয়।

এর পরেই একসময়ের নিরুপদ্রব বুরকিনা ফাসো অশান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। ২০১৫ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে অসংখ্য সংঘর্ষে বহু প্রাণহানি ঘটে। অন্তত সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয় রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিবাহিনী। এর পর সে দেশে সেনা অভ্যুত্থান হয়। বুরকিনা ফাসোর অন্ধকার অধ্যায়ে আশার আলো জাগান সেনাকর্তা ইব্রাহিম। একজন তরুণ এবং প্রগতিশীল নেতা হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় তার। ২০২২ সাল থেকে বুরকিনা ফাসোর অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ইব্রাহিম। ৩৭ বছর বয়সি ইব্রাহিম বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান।

দেশের পাশাপাশি আফ্রিকার অন্যান্য জায়গাতেও সমান সমাদৃত তরুণ নেতা ইব্রাহিম। কিন্তু কেন এত জনপ্রিয়তা বুরকিন ফাসোর এই সেনাকর্তার?

দেশকে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ এবং নব্য-উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইব্রাহিম। তার বার্তা আফ্রিকা এবং তার বাইরেও নাকি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ইব্রাহিমের অনুরাগীরা তাকে বুরকিনা ফাসো তথা আফ্রিকার অন্যতম বিপ্লবী নেতা টমাস সাঙ্কারার যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবেও দেখছেন।

ইব্রাহিমের প্রভাব রয়েছে বুরকিনা ফাসোর বাইরেও। এমনকি কেনিয়ার মতো দেশের রাজনীতিবিদদের মুখেও বার বার উঠে এসেছে তার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে রাশিয়ায় সম্প্রতি একটি স্মরণসভায় যোগও দিয়েছিলেন ইব্রাহিম। ২০২৩ সালে রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে আফ্রিকার নেতাদের ‘সাম্রাজ্যবাদীদের কথায় নাচা পুতুলের মতো আচরণ বন্ধ করার’ বার্তা দিয়েছিলেন ইব্রাহিম। সেই বার্তার মাধ্যমে আফ্রিকার বাকি দেশগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বুরকিনা ফাসোর তরুণ নেতা।

রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম ইব্রাহিমের সেই ভাষণ ব্যাপক ভাবে প্রচার করেছিল। এর পরেই হইচই পড়ে যায়। আফ্রিকার মানুষদের কাছে ইব্রাহিমের ভাবমূর্তিকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল তার সেই ভাষণ।

২০২২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সকে ছেড়ে রাশিয়ার সঙ্গে একটি শক্তিশালী জোট করেন ইব্রাহিম। রুশ আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করার পরিবর্তে দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খনি সংস্থা তৈরিতে রাশিয়ার সাহায্য চান। এমনকি রুশ খনি সংস্থাকে অনুরোধ করেন দেশের মানুষকে কাজ শেখানোর বন্দোবস্ত করে দিতে।

বুরকিনা ফাসোর খনিজ সম্পদ থেকে লাভবান হওয়া নিশ্চিত করার জন্য ইব্রাহিম ইতিমধ্যেই একটি স্বর্ণ শোধনাগার তৈরি করিয়েছেন সে দেশে। বুরকিনা ফাসোর ইতিহাসে প্রথম বারের মতো জাতীয় স্বর্ণভান্ডার তৈরি করেছেন তিনি। ইব্রাহিমের সরকার লন্ডনের একটি সংস্থার মালিকানাধীন দু’টি স্বর্ণখনিও নিজেদের দখলে নিয়েছে। আরও বিদেশি মালিকানাধীন খনি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে দেশটি।

ফলে নিঃসন্দেহে ইব্রাহিমকেই এখন আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসাবে দেখছেন দেশের মানুষ। বুরকিনা ফাসোর জনগণের কাছে পরিত্রাতায় পরিণত হয়েছেন তিনি। সমাজমাধ্যমেও তার সেই জনপ্রিয়তা ফুটে উঠেছে।

বুরকিনা ফাসোর জনগণের একাংশের মতে, ইব্রাহিম ক্ষমতায় আসার পর উন্নত হচ্ছে দেশটি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য পরিকাঠামো মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই বুরকিনা ফাসোর বাসিন্দাদের জন্য ১,০০০টি আবাসন তৈরির একটি প্রকল্পে হাত দিয়েছেন তিনি। ২০৩০ সালের মধ্যে সে দেশের মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।

অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্যও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইব্রাহিম। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের আর্থিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করে দেশীয় সম্পদের মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়ার কথা বলেছেন তিনি। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কৃষি, স্থানীয় শিল্প এবং উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বুরকিনা ফাসোর তরুণ নেতা।

সম্প্রতি বুরকিনা ফাসোয় ২০০টি মসজিদ তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল সৌদি আরব। কিন্তু সৌদির দেওয়া সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন ইব্রাহিম। মসজিদের পরিবর্তে দেশটিতে স্কুল-হাসপাতাল তৈরি এবং কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এমন ব্যবসায় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।

ইব্রাহিম যুক্তি দিয়েছেন, বুরকিনা ফাসোয় ইতিমধ্যেই পর্যাপ্ত সংখ্যক মসজিদ রয়েছে, এর মধ্যে অনেকগুলি এখনও অব্যবহৃত। তিনি এমন সব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন, যার ফলে সরাসরি উপকৃত হবেন বুরকিনাবাসীরা। তার এই সিদ্ধান্তের পর সে দেশের জনগণের মধ্যে ইব্রাহিমকে নিয়ে চর্চা আরও জোরদার হয়েছে।

ইব্রাহিমের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও পশ্চিমি শক্তিগুলি অবশ্য তার নেতৃত্বের ধরন ‘কর্তৃত্ববাদী’ এবং ‘বিতর্কিত’ বলে তকমা দিয়েছে। পাশাপাশি, ১০ বছরের ‘ইসলামপন্থী বিদ্রোহ’ দমন করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতেও ব্যর্থ হওয়ার কালি লেগেছে ইব্রাহিমের উর্দিতে।

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com