
সংগৃহীত ছবি
ঢাকা: জাতীয় নির্বাচনের আগে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আসন ভাগাভাগির সমীকরণ দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। বিষয়টি নিয়ে মিত্র দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে। শরিকদের অভিযোগ, অনেক বিএনপি নেতা এমন নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন, যেখানে মিত্র দলের নেতারাও মাঠে আছেন। তারা বলছেন, বিএনপি তৃণমূল প্রার্থীদের লাগাম টানতে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) প্রস্তাবিত পরিবর্তনের পরে বিষয়টি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। কারণ এই পরিবর্তনে মিত্র দলগুলো বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে প্রার্থী হতে পারবেন না।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা স্বীকার করেছেন, মনোনয়ন না পেয়ে অনেক নেতা ক্ষুব্ধ হবেন। তাদের শান্ত করা সহজ হবে না। আবার তাদের জায়গায় জয়ের সম্ভাবনা কম এমন মিত্রদের আসন দেওয়ার ব্যাপারটি কঠিন হবে।
জোটের দুটি দলীয় প্রধান বলেছেন, বিএনপিকে শিগগির তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তারা বলেন, “বিএনপি নেতারা মনোনয়ন চাইছেন। কিছু আসনে মিত্র দলের প্রার্থী থাকার পরও তারা প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাই সময় থাকতে বিএনপির উচিত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করা।”
গত দুই দিনে সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রায় ২৫ জন জোট নেতা একই মত প্রকাশ করেছেন। এই দলগুলো পতিত আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় বিএনপির সঙ্গে ছিল।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের তথ্য মতে, প্রায় ৫৩টি দল তাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। এর আগে, বিএনপি নির্বাচিত হলে জোট শরীকদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেছেন, জোটে থাকা সেইসব নেতাদের জন্য আসন ছাড়া হবে, যাদের জয়ের সম্ভাবনা আছে। গত আগস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় ৬০ জন নেতাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, জোটের নেতারা ভবিষ্যতে তাদের সরকারের অংশ হবে।
দলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, তিনি নির্বাচনী প্রচারণা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং জরিপের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার ব্যাপারে ধারণা নিচ্ছেন।
পরাজয়ের ঝুঁকি
বিএনপি প্রার্থীরা সতর্ক করেছেন, জোটের দুর্বল প্রার্থীদের আসন ছেড়ে দিলে দলের জন্য বড় ক্ষতি হতে পারে। যেমন ঝিনাইদহ-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান ও বিএনপি জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মজিদ প্রচারণা চালাচ্ছেন।
মজিদ বলেন, “দল যদি রাশেদকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে বিএনপি এই আসন হারাবে। রাশেদ এখানে সক্রিয় না, এখানে তার তেমন সমর্থক নেই।”
তবে আব্দুল মজিদের এই দাবির সঙ্গে একমত নন রাশেদ খান। শনিবার রাতে রাশেদ খান বলেন, একজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এ ধরনের মন্তব্য করা ‘উচিত না’।
তার ভাষ্য, “আমি নিয়মিত এলাকায় যাই, মানুষের সঙ্গে দেখা করি। আমার এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসে।”
একই ধরনের পরিস্থিতি আরও অনেক আসনে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি প্রচারণা চালাচ্ছেন। সেখানে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেকও মনোনয়ন প্রত্যাশী। আব্দুল খালেক মনে করেন, এই আসনে বিএনপির প্রতীক ছাড়া সাকির জেতার সম্ভাবনা ‘শূন্য’।
এই দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে জোনায়েদ সাকি বলেন, “আমরা নিজেদের মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে। বিএনপি যেসব আসন ছেড়ে দেবে, সেখানে তাদের নেতাকর্মীদের কীভাবে ম্যানেজ করবে, সেটা তারা ঠিক করবে।”
কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এহসানুল হুদা ও বিএনপির মুজিবুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। মুজিবুর জানান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একটি চিঠি দিয়ে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের কথা বলেছে। তবে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বলেনি।
পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর ও বিএনপির হাসান মামুন প্রচারণা চালাচ্ছেন। মামুন বলেন, “নূরকে ছেড়ে দিলে এই আসন বিএনপি হারাবে। স্থানীয়রা এখানে বিএনপির নেতা চায়, কোনো মিত্র দলের কাউকে না।”
এই জেলায় ইতোমধ্যে ভোটের উত্তেজনা ও আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। জুনে গলাচিপা উপজেলায় বিএনপি ও গণঅধিকার কর্মীদের সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন। বিএনপির একটি অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-৪ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে বিএনপির একজন প্রার্থীও মনোনয়ন চেয়েছেন। একই আসনের বিএনপি নেতারা জানান, জোটের কোনো দুর্বল প্রার্থীকে এই আসন ছেড়ে দিলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা সুবিধা নেবে।
শরিকদের হতাশা
জোট নেতারা বলছেন, আসন নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে বিএনপি দেরি করছে। এতে সবার মধ্যে ভুল বোঝাবোঝি বাড়ছে। মান্না বলেন, “আমার এলাকায় আমাদের এক নেতাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আমি বিষয়টি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছি, কিন্তু কিছুই হয়নি। কেন্দ্রীয় নির্দেশের পরেও যদি তৃণমূল নেতারা নির্দেশনা না মানেন, তাহলে বলার কিছু নেই।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক সতর্ক করে বলেন, বিএনপি তাদের শরিকদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করালে ‘কোনো ভালো বার্তা যাবে না’।
বিএনপির সমমনা দল জাগপার সভাপতি খন্দকার লুৎফুর রহমান বলেন, কোনো আসনে বহিরাগত প্রার্থী দেওয়া হলে দলে ভুল বোঝাবুঝি বাড়বে। বিএনপির নেতারা মনে করতে পারেন, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি মনে করেন, কোনো মিত্র দলের প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যদি বিএনপির কেউ হন, তাহলে সেটি তার জন্য ‘অস্বস্তিকর’ হয়ে দাঁড়াবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১২-দলীয় জোটের পাঁচ নেতা স্বীকার করেন, তৃণমূলে তাদের সংগঠন বিএনপির চেয়ে অনেক দুর্বল। “বিএনপি যদি এখনই এটার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে পরে কীভাবে করবে?” প্রশ্ন তোলেন একজন।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, মিত্রদের প্রার্থী তালিকা জমা দিতে বলা হয়েছে। একযোগে প্রচারণা শুরু করতে আসন ভাগাভাগির আলোচনা এ মাসেই শেষ হতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, যেখানে জোট নেতাদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। তারা সেই আসনগুলো ছেড়ে দিতে চান।
পালাবদল/এসএ