চুক্তি সই অনুষ্ঠানে বাঁ থেকে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রিয়াদ। ছবি: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর/এক্স
কূটনীতিতে ব্যক্তিগত রসায়নই যে শেষ কথা নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তা ফের নতুন করে মনে করিয়ে দিল কংগ্রেস। সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তির পর সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে কংগ্রেস বলেছে, কূটনৈতিক দিক থেকে ওই চুক্তি আরও এক বড় ধাক্কা।
কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বৃহস্পতিবার ওই চুক্তি প্রসঙ্গে বুঝিয়ে দেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার ব্যক্তিগত রসায়নের যে উল্লেখ করেন, কূটনীতিতে তা অর্থহীন। ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে এক পোস্টে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, পেহেলগামে যেদিন হামলা হয়, প্রধানমন্ত্রী সেদিন সৌদি আরবে ছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই সৌদি আরব প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলল।
পোস্টে জয়রাম আরও উল্লেখ করেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’–এর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘটা করে চীন সফর করলেন। তার পরপরই চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং বেইজিংয়ের গোপন সামরিক ভবনের দরজা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির জন্য খুলে দিলেন।
কংগ্রেস নেতা উল্লেখ করেন, প্রতিটি ঘটনাই ভারতের নিরাপত্তার জন্য গভীর উদ্বেগের। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, প্রধানমন্ত্রী মোদির তথাকথিত ব্যক্তিগত রসায়নের কূটনীতি কতটা ব্যর্থ।
বস্তুত, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে গত বুধবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে যে কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়, তা ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। কারণ, চুক্তিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের কেউ আক্রান্ত হলে তা দুই দেশের ওপর ‘আগ্রাসন’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে ওই চুক্তি নিয়ে ভারত খুবই সতর্কভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট সংযত। আগ বাড়িয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য না করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর এই চুক্তির কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, ভারত তা খতিয়ে দেখছে। সরকার দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক বহু পুরোনো। ১৯৬০–এর দশক থেকেই সৌদি সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তানি বাহিনী সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ভারত–সৌদি সম্পর্কও মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে দৃঢ় হতে শুরু করেছে। ২০০৬ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ ভারত সফরে এসেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সৌদি আরব সফর করেন ২০১০ সালে। ২০১৬ সালে রিয়াদে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিন বছর পর ২০১৯ সালে পাল্টা ভারতে আসেন যুবরাজ মহম্মদ বিন সালমান। মোদিও সেই বছর দ্বিতীয়বার সৌদি সফরে যান। যুবরাজও শেষবার ভারত সফরে আসেন ২০২৩ সালে। পেহেলগামে হামলার সময়েও মোদি ছিলেন সৌদি আরবে।
দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক যখন জোরদার এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’ বাতিল না করে ভারত যখন তা স্থগিত রাখার কথা জানিয়েছে, তখন চুক্তির জন্য এই সময়টা বেছে নেওয়া ভারতকে ভাবাচ্ছে। চুক্তি সইয়ের সময় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরও উপস্থিত ছিলেন।
ভারত মনে করছে, এই সময়ে এমন চুক্তি সইয়ের একটা সম্ভাব্য কারণ হয়তো ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাব। মাত্র কয়েক দিন আগে ৯ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের প্রতিবেশী কাতারের রাজধানী দোহায় আকাশপথে আক্রমণ চালিয়েছিল ইসরায়েল। যদিও ইসরায়েলের দাবি, সেই হানার লক্ষ্য ছিল হামাস নেতৃত্ব।
ইসরায়েলের ওই হামলাকে আরব দেশগুলো ভালোভাবে নেয়নি। আরব লিগ ও ওআইসির বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। তারপরেই এই চুক্তি। সৌদি দৃষ্টিতে চুক্তির মুল লক্ষ্য ইসরায়েল মনে করা হলেও পাকিস্তানের দিক থেকে ওই চুক্তি ভারতের ভবিষ্যৎ আক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ মনে করা হচ্ছে। সেটাই ভারতের চিন্তার কারণ।
ভারতের কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, চিন্তা বা দুশ্চিন্তা যা–ই হোক না কেন, এমন কোনো মন্তব্য করা হবে না, যাতে সৌদি–ভারত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে চিড় ধরে।
ভারত ও সৌদি আরবের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ গত অর্থবছরে ছিল প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। সৌদি আরবে ২৫ লাখ ভারতীয় কাজ করেন। ২০২২–২৩ অর্থবছরে সৌদি আরবে কর্মরত ভারতীয়রা ৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার দেশে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পাঠিয়েছিলেন।