সোমবার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ৭ আশ্বিন ১৪৩২
সোমবার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
 
দক্ষিণ এশিয়া
‘আমরা ভুগছি আর রাজনীতিবিদেরা ধনী হচ্ছেন, তাই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার ফেলে দিয়েছি’





বিবিসি
Thursday, 18 September, 2025
4:23 PM
 @palabadalnet

নেপালের কাঠমান্ডুতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে এক আন্দোলনকারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ও সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, নেপাল। ছবি: এএফপি

নেপালের কাঠমান্ডুতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে এক আন্দোলনকারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ও সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, নেপাল। ছবি: এএফপি

নেপালে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে জেন–জিদের বিক্ষোভে সরকারের পতন ঘটেছে। তবে এ জয় এসেছে চড়া মূল্যে।

বিক্ষোভের সংগঠকদের একজন তনুজা পান্ডে। তিনি বলেন, “আমরা গর্বিত হলেও এর সঙ্গে মানসিক আঘাত, অনুশোচনা ও ক্ষোভের মিশ্র বোঝাও যোগ হয়েছে।”

হিমালয়ের দেশ নেপালে গত সপ্তাহের বিক্ষোভে ৭২ জন নিহত হয়েছেন। এটিকে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অস্থিরতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিক্ষোভে সরকারি ভবন, রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবন ও গত বছরের জুলাইয়ে চালু হওয়া হিলটনের মতো বিলাসবহুল হোটেলে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী এখনো জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সংকটবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আশীষ প্রধান বলেন, “এই বিক্ষোভ দশকের পর দশক ধরে নেপালের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের বিরুদ্ধে বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত বহন করে।”

তবে আশীষ আরও উল্লেখ করেন, বিক্ষোভের কারণে সরকারি সেবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের সমান্তরাল হতে পারে। ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শুধু রাজধানী কাঠমান্ডুতে এ ধ্বংসযজ্ঞ সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিক্ষোভে সারা দেশে কমপক্ষে ৩০০টি স্থানীয় সরকারি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিক্ষোভের কারণে প্রায় তিন লাখ কোটি নেপালি রুপির (২ হাজার ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার) ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় অর্ধেক। এ সময় নেপালের বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

৮ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ বিক্ষোভ শুরুর দুই দিন আগে ২৪ বছর বয়সী পরিবেশকর্মী তনুজা পান্ডে একটি ভিডিও আপলোড করেন। ভিডিওতে তিনি অঞ্চলটির অন্যতম সংবেদনশীল পর্বতশ্রেণি চুরেতে একটি খনি দেখান। তিনি লিখেছিলেন, “নেপালের সম্পদের মালিকানা শুধু জনগণের। রাজনীতিবিদদের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নয়।” এ সময় সমবয়সীদের প্রতি “দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে” বিক্ষোভের আহ্বান জানান তিনি।

এশিয়ায় তরুণদের অন্যান্য আন্দোলনের মতো নেপালের জেন-জিদের বিক্ষোভও ছিল নেতৃত্বহীন। দীর্ঘদিন ধরে “নেপো বেবিজ’দের (ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদদের সন্তানদের) বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধ সম্পদের আড়ম্বরপূর্ণ প্রদর্শনীর অভিযোগ আনা হয়।

সবচেয়ে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর মধ্যে একটিতে প্রাদেশিক মন্ত্রীর ছেলে সৌগত থাপাকে দেখা গেছে। ছবিতে তাকে লুই ভুতোঁ, গুচি, কার্টিয়ারসহ বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের বাক্স দিয়ে তৈরি একটি ক্রিসমাস ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এর জবাবে সৌগত দাবি করেন, ছবিটি নিয়ে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ দেওয়া হচ্ছে। তার বাবা ‘জনসেবা থেকে উপার্জিত প্রতিটি রুপি’ জনগণের কাছে ফেরত দিয়েছেন।

তনুজা পান্ডে বলেন, এটা দুঃখজনক যে শিক্ষিত তরুণেরাও দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, এখানে যে বেতন দেওয়া হয়, তা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় অনেক কম।

নেপালের গণতন্ত্র খুব একটা পুরোনো নয়। মাওবাদীদের নেতৃত্বে এক দশকের গৃহযুদ্ধের পর ২০০৮ সালে নেপাল একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। সেই সময় ১৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু এরপরেও প্রতিশ্রুত স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি আসেনি। ১৭ বছরে নেপালে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে এবং কোনো নেতাই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।

কটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তনুজা পান্ডের জন্ম। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষক। তিন বছর আগে তনুজার মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ে। এখনো তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বিক্ষোভ শুরুর আগে তনুজা অন্যদের সঙ্গে নিয়ে অহিংসা ও পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখতে কিছু নির্দেশনা তৈরি করেন। আন্দোলন কেউ যেন “ছিনতাই’ করে নিতে না পারে, সে বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের সতর্ক করেন তিনি।

৮ সেপ্টেম্বর সকালে তনুজা পান্ডে তার কয়েকজন বন্ধুসহ মাইটিঘর মান্ডালায় পৌঁছান। এটি কাঠমান্ডু শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বিশাল ট্রাফিক আইল্যান্ড। তনুজা ভেবেছিলেন, সেখানে হয়তো সর্বোচ্চ কয়েক হাজার মানুষ আসবেন। কিন্তু ক্রমেই ভিড় বাড়তে থাকে।

২৬ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী আক্রতি ঘিমিরে বলেন, “শুরুতে পরিস্থিতি শান্ত ও সম্প্রীতিপূর্ণ ছিল।” তিনি বলেন, “আমরা সবাই বসে ছিলাম, পুরোনো নেপালি গান গাইছিলাম। স্লোগান আর পুরো পরিবেশ এতটাই মজার ছিল যে আমরা পরিস্থিতি উপভোগ করছিলাম। এরপর আমরা মিছিল শুরু করি...কোনো যানবাহন যেন আমাদের পথে বাধা সৃষ্টি না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সেখানে ছিল।”

দিনের মাঝামাঝি সময়ে তনুজা পান্ডে ও আক্রতি ঘিমিরে উভয়ই বিপদ আঁচ করতে শুরু করেন। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা নিউ বানেশ্বর এলাকায় অবস্থিত সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন।

আক্রতি ঘিমিরের ধারণা, বিক্ষোভে কিছু অনুপ্রবেশকারী ছিল। তিনি বলেন, “শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সহিংসতার উদ্দেশ্য নিয়ে আসা মানুষদের আলাদা করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল।”

কিছু বিক্ষোভকারী সংসদ ভবনের চারপাশের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও গুলি ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার ও হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের বিরুদ্ধে স্কুলের শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি ছোড়ার অভিযোগের পাশাপাশি তাজা গুলি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

পরদিন সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অন্যান্য সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করেন। এদিন তনুজা পান্ডে ও আক্রতি ঘিমিরে বাসায় থেকে অনলাইনে ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেন।

আক্রতি ঘিমিরে বলেন, “অনেকেই রাজনীতিবিদদের অবশেষে তাদের কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেখে তাদের ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু খুব দ্রুত পরিস্থিতি এক অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকে মোড় নেয়।”

তনুজা বলেন, “আমি মানুষের হাতে পেট্রলভর্তি বোতল দেখেছি। তারা সেগুলো মোটরবাইক থেকে পেয়েছিলেন। এরপর তারা সংসদ ভবনে আক্রমণ শুরু করেন।”

আইনে স্নাতক এক তরুণী সুপ্রিম কোর্ট ভবনে অগ্নিসংযোগ দেখে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, এটি তার কাছে “একটি মন্দিরের’ মতো ছিল।

নেপালে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। কয়েক দিনের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। সপ্তাহের শেষের দিকে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। এই পদের জন্য বিক্ষোভকারীদের পছন্দের তালিকায় ছিলেন তিনি।

তনুজা পান্ডের আশা, “সুশীলা কারকি দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা ফির‍িয়ে দিতে পারবেন।”

তবে এরপরও নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ রুমেলা সেন বলেন, “সেনাবাহিনীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে মহিমান্বিত করার বিষয়টি উদ্বেগজনক।”

এদিকে নিহত বিক্ষোভকারীদের পরিবার স্বজন হারানোর বেদনা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

যুবরাজ নেউপানের ২৩ বছর বয়সী ছেলে যোগেন্দ্র বিক্ষোভে নিহত হন। ছেলেহারা এই বাবা বলেন, “আমরা আমাদের প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে গভীরভাবে শোকাচ্ছন্ন হয়ে গেছি।” তিনি আরও বলেন, “সে কীভাবে মারা গেল, আমি এখনো তা জানতে পারিনি।”

যোগেন্দ্র নেউপানের দাদা সৌভাগ্য নেউপানে বলেন, “পরিবর্তনের দাবিতে আমাদের প্রিয়জন তার জীবন দিয়েছেন। তার রক্ত ও ত্যাগের স্বীকৃতি পেলে ভবিষ্যতে অন্য তরুণদের আর রাস্তায় নামতে হবে না।”

তনুজা পান্ডে বলেন, তিনি নেপালের ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদী। তবে গত সপ্তাহের মানসিক আঘাত তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

এই নেপালি তরুণী বলেন, “আমরা আর নীরব থাকতে বা অন্যায়কে মেনে নিতে রাজি নই। এটি কেবল একটি মৃদু ধাক্কা নয়; বরং দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ব্যবস্থার প্রতি এক সাহসী চ্যালেঞ্জ।”

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com