বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫ ১৩ চৈত্র ১৪৩১
বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫
 
বিনোদন
চলে গেলেন ‘আমি বাংলায় গান গাই’ এর প্রতুল মুখোপাধ্যায়





পালাবদল ডেস্ক
Saturday, 15 February, 2025
3:37 PM
 @palabadalnet

প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় মারা গেছেন। আজ শনিবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ভারতের সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমস। 

জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। ১৯৪২ সালে। বাবা প্রভাতচন্দ্র ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা বীণাপাণি মুখোপাধ্যায় গৃহবধূ। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। স্কুলে পড়াকালীনই তার এক আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পান নিকটজনেরা। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে বন্ধুদের চমকে দিয়েছিলেন প্রতুল। পাশাপাশি নিজেও লিখতে থাকেন ছড়া, গানের লিরিক। চাকরি করেছেন আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত গেরস্তের মতোই। কিন্তু সেই গেরস্থালির মধ্যেই কোথাও যেন আগুন ছিল। ধিকিধিকি গানের আগুন। বিপ্লব, স্বপ্নভঙ্গ আবার বিপ্লব আর আবার স্বপ্নভঙ্গের বঙ্গীয় রাজনীতির অনেক উথালপাথালের সাক্ষী প্রতুল রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন সমাজতন্ত্রের শরিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বোধ হয় মানুষ আর মানবতাকে তার গানে সবার আগে রাখতেন।

কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই শুধুমাত্র ‘বডি পারকাশন’ ব্যবহার করে গানের রেওয়াজ গণনাট্যের গানেও ছিল না। বরং সেখানে গান ছিল যূথবদ্ধ মানুষের হারমনির উপরে দাঁড়িয়ে। ‘কয়্যার’ বা যৌথ গানের সঙ্গে মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াই বা দিনবদলের স্বপ্ন ইত্যাদির অঙ্গাঙ্গী যোগ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতুল সে রাস্তায় হাঁটলেন না। তার গান সে অর্থে তাই ‘গণসঙ্গীত’ হয়েও যেন হল না। এমনকি, মঞ্চে গাওয়ার সময়েও (মঞ্চের বাইরেও হাটে-মাঠে-ঘাটে) কোনও যন্ত্রীকে সঙ্গে নিলেন না। কখনও নিজের গাল কখনও বা বুক বাজিয়ে, তুড়ি দিয়ে, হাততালি দিয়ে গাইতে লাগলেন নিজের বাঁধা গান। গায়ক একা হয়েও যেন একা নন। তার সঙ্গী তারই দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। প্রতুলের গান গণনাট্যের গানেরই উত্তরাধিকার হলেও তার থেকে তার স্বাতন্ত্র্য প্রধানত ওই এক জায়গাতেই।

গণনাট্যের গানের যৌথতা কি বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গে ছত্রখান হয়ে গিয়েছিল? তার পরে বাংলা মূলধারার গানে সে অর্থে যৌথতা আর দেখা যায়নি। সত্তরের দশকের আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া গানে (যদিও তার সংখ্যা তেমন বেশি নয়) যৌথতা এক ঝলক উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। ওই পর্যন্তই। বাংলা গানের মূলধারায় তাই ‘কয়্যার’ বা ব্যান্ডের ঐতিহ্য প্রান্তিকই ছিল বলা যায়। নব্বইয়ের দশকে সুমনের উত্থান বাংলা মূলধারার গানের গীতিকার-সুরকার-গায়কের ফর্মুলা তছনছ করে দেয় এবং সুমনের সুবাদেই নব্বইয়ে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে কদম রাখা ছেলেপুলেরা শুনতে শুরু করে ‘এককের গান’।

প্রতুলের প্রথম অ্যালবাম ‘যেতে হবে’ (১৯৯৪) প্রকাশের পর একেবারে অন্য রকম এক শ্রুতির সামনে গিয়ে পড়েন শ্রোতারা। মঞ্চে প্রতুল যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জন করলেও এই অ্যালবামে করেননি। তার গানের পিছনে বহু দূরের দিগন্তরেখার মতো থেকেছে যন্ত্র। গানই সেখানে মুখ্য। ইন্টারল্যুডে প্রতুলের নিজেরই কণ্ঠ বেজেছে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা! সর্বোপরি তার কণ্ঠ, স্বরক্ষেপণ এবং উচ্চারণ। মধুমাখা বাংলা আধুনিকের জগতে সে যেন এক মূর্তিমান ভাঙচুর। ‘সুকণ্ঠ’ নিয়ে গরবে গুমরোনো বাংলা গানের জগতে প্রতুল তার প্রবল রকমের ‘ম্যানারিজম’ নিয়ে যেন সত্তর দশকের কবি সুব্রত সরকারের উচ্চারণেই বলে উঠলেন, ‘সহ্য করো, বাংলাভাষা’।

বাংলা তাকে সহ্যই শুধু করল না, আদরে-আশ্লেষে বুকেও টেনে নিল। ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’-র তরঙ্গপ্রতিম স্বরক্ষেপণ আর ‘ঙ্গ’-এ জোর দেওয়া উচ্চারণ বুঝিয়ে দিল, তিনি একেবারে আলাদা কিসিমের এক গানওয়ালা। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ তখন কলেজ ক্যান্টিনে, ফেস্টে, ফেস্টুনে একাকার। ‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, তৃপ্ত শেষ চুমুক’-এমন শব্দচয়ন যে বাংলা গানে উঠে আসতে পারে, তা নব্বই দশকের ফুটতে থাকা কবিকুলও ভাবতে পারেননি। বইমেলার মমাঁর্ত মঞ্চে অথবা না-মঞ্চের জটলাতেও প্রতুল গেয়ে উঠছেন চার্লি চ্যাপলিনের অমর সুরসৃজন ‘লাইমলাইট থিম’-এর বঙ্গান্তর। সেই উচাটন সুরে বসিয়ে দিয়েছেন ভবঘুরে চার্লিকেই উৎসর্গ করা ভালোবাসার কথা। চার্লির সুর যদি ব্যক্তিমানুষের একান্ত ভালবাসার অভিজ্ঞান হয়ে থাকে, তবে তাতে প্রতুলের লিরিক ছিল সর্বজনীন ভালোবাসার বালুচরি-নকশা। সে গানে যেন লেগে ছিল প্রেমের আবরণ-আভরণহীন উদ্দামতা।

পিঠোপিঠি অ্যালবাম ‘ওঠো হে’। সময়ের ঝুঁটি ধরে উঠতে বললেন প্রতুল। কোথাও কি মিশে গেল নাটকের গানের নাটকীয়তা? প্রতুলের গান অ্যালবামে শোনা আর তার মঞ্চের পারফরম্যান্স প্রত্যক্ষ করার মধ্যে ছিল আসমান-জমিনের ফারাক। শুধু বডি পারকাশনের প্রয়োগ নয়, প্রতুলের দুই চোখ, মুখাবয়ব, শরীরের অভিব্যক্তি যেন গেয়ে উঠত একসঙ্গে। ‘সাপের মাথায় পা দিয়ে সে নাচে’ অথবা ‘নকোসি সিকেলে আফ্রিকা’ যারা মঞ্চে দেখেছেন, তারা জানেন কী ছিল সেই উপস্থাপনে। শুধু নিজের লেখা গান নয়, অন্য ভারতীয় ভাষার কবিদের কবিতা অনুবাদ করে গানে নিয়ে গিয়েছেন তাদের। সুর দিয়েছেন কবি অরুণ মিত্রের ‘আমি এত বয়সে’-র মতো গদ্যকবিতাতেও। সেই গানের মধ্যে যেন মরুপ্রান্তরের হাওয়াঘেরা হাহাকার ঢেলে দিয়েছিলেন প্রতুল। ‘লাইমলাইট’-এর আর্দ্রতা সেখানে নেই, ‘ডিঙ্গা ভাসাও’-এর লবণস্নিগ্ধ সমদ্রঝাপট সে গানে অনুপস্থিত। সে গান গদ্যের কারখানাশব্দ আর প্রান্তবয়সের কবির হাহাকারের যুগলবন্দি।

এরই সঙ্গে প্রতুল গেয়েছেন ছোটদের জন্য। ‘কুট্টুস কট্টাস’ নামের অ্যালবামে প্রায় প্রতিটি গানে রয়েছে কেমন এক সস্নেহ প্রশ্রয়ের টান। সুমন-নচিকেতা-অঞ্জনের ‘ছোট বড় মিলে’ আর প্রতুলের এই অ্যালবামই কি পশ্চিমবেঙ্গর শেষ ‘ছোটদের গান’? যে কাজ সলিল চৌধুরী শুরু করেছিলেন অন্তরা চৌধুরীকে দিয়ে, সেই কাজটি ছিল ছোটদের ‘বড়’ হয়ে ওঠার জন্য গান বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ। প্রতুল তার সেই অ্যালবামে সেই কাজেরই উত্তরাধিকার বইলেন।

একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রতুল বলেছেন, সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা তার ছিল না। তার ভাষায়, “আমি শুনে শুনে, ঠেকে ঠেকে শিখেছি।” তার শ্রোতাদেরও প্রথমে হোঁচট খেতে হয়েছিল তার গান শুনতে বসে। একজন মানুষ কণ্ঠ, প্রশিক্ষণ, পরিমার্জন-সব কিছুকে পাশে সরিয়ে রেখে কী করে হয়ে উঠছেন ‘আস্ত একটা গান’, তা আগামী প্রজন্মকে ভেবে উঠতে গেলেও ভাবনার জিমন্যাশিয়ামে ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। কী করে সম্ভব হয়েছিল তা, এখন আর মনে পড়ে না নব্বই দশকে যুবক হয়ে উঠতে থাকা প্রজন্মের। মাথার উপর এক স্থবির রাজনীতি আর তার সুবাদে চারিপাশে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’-সুলভ একটা ‘ফিল গুড’ ভাবকে যে হাতেগোনা কয়েক জন দুমড়ে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রতুল অন্যতম।

হয়তো সেটা ‘সময়ের দাবি’। কিন্তু সময় কি তার পরে আর দাবি জানাতে পারল না? ‘আমি বাংলায় গান গাই’ পরে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা মূলধারার সিনেমায়। সেখানে সে গানের ধার কেমন যেন ভোঁতা। ‘দৃপ্ত স্লোগান’ আর ‘তৃপ্ত শেষ চুমুক’-কে ধরতে পারেনি উত্তর-বিশ্বায়ন পর্বের বাংলা। পশ্চিমবেঙ্গে বাংলা গানের নব্বইয়ের ‘নবজোয়ার’ স্তিমিত হয়ে এসেছিল মিলেনিয়াম পর্বেই। তবু কখনও বইমেলার মাঠে লাউডস্পিকারে বেজে উঠত ‘ডিঙ্গা ভাসাও’ বা ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’। এখনও বাজে বোধ হয়। আগামীতেও বাজবে। কিন্তু সেই গানের আত্মাটি সম্ভবত থাকবে না। কারণ, সেই গানমানুষের সৃষ্টি অ্যালবামে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাকে তিনি নিজের সঙ্গে করেই নিয়ে গেলেন। তার গান ছিল আক্ষরিক অর্থেই নগর কবিয়ালের গান। যে কোনও আসরে অথবা আসর ছাড়াও গেয়ে ফেলা যেত। বাস্তবে আজীবন রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত ছিলেন প্রতুল। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের কালেই তারা গানের জারণ। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে তাকে দেখা গিয়েছে। সম্ভবত প্রতিবাদকেই গান আর জীবনের সঙ্গে একাত্ম করতে চেয়েছিলেন প্রতুল।

বব ডিলান তার একটি গানে নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, “ওভার এক্সপোজড, কমার্শিয়ালাইজ়ড/ হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।’’ প্রতুল সেই ‘কেয়ার’টিকেই কেয়ার করেননি কখনও। তার গান ভেসে থাকল পলাশফুলের ঝরে পড়া পাপড়ির মতো। যা হাওয়ায় ভাসে না। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। তার সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে গেলে যেতে হয় পড়ে থাকা ফুলের কাছেই। হাতে তুলে নিলে তারা গান হয়ে যায়, কবিতা হয়ে যায়, স্বপ্ন হয়ে যায় দিনবদলের। কিন্তু তার জন্য ওই যে, “যেতে হবে!” দূরে, বহু দূরে, আরও, আরও দূরে…।

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2024
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com