বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অপরাধমূলক ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর প্রশ্ন উঠছে যে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটির নেতাকর্মীরা ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে কি-না কিংবা দলটি মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কি-না।
যদিও গত বছর পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে নানা অপরাধমূলক ঘটনায় নাম আসার পর দলটির বিভিন্ন স্তরের বহু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।
তারপরেও হামলা, দখল, চাঁদাবাজি, থানায় প্রভাব বিস্তারসহ নানা ধরনের অভিযোগ প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা, ভোলায় ধর্ষণের ঘটনা, খুলনায় পুলিশ কর্মকর্তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও কিছু ঘটনা আলোচনায় এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে অনেকে শুরুতে ক্ষোভ থেকে হামলা, চাদাবাজি ও হাঙ্গামায় জড়িয়েছেন। এখন আবার বহু বছর পর মাঠ পর্যায়ে অনেকটা 'সরকারি দলের' আমেজে থাকলেও বিএনপি এখনো ক্ষমতায় আসেনি, যার ফলে কর্মী সমর্থকরা কেউ অপরাধে জড়ালে কার্যত দলটির আর কিছু করার নেই- এ সুযোগেই অনেকে অপরাধে জড়াচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
“দলটির শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে চেইন অব কমান্ড কাজ করছে না বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া অনেকেই ভাবছেন নির্বাচন কবে হবে ঠিক নেই- এই সুযোগে আগেই যা করার করে নেই। দলটির অনেকে অপরাধে জড়ানোর এটিও একটি কারণ,” বিবিসি বাংলাকে বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান।
তবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য ইতোমধ্যেই তারা বহু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। সেই সাথে প্রশাসনকেও আহবান জানিয়েছেন যে কেউ অন্যায় করলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
“বিএনপি বড় দল। কোনো ঘটনার জন্য ঢালাওভাবে দলকে দোষারোপের সুযোগ নেই। তবে একটি পক্ষ কিছু ঘটলেও বিএনপির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা শুরু করে। আমরা প্রশাসনকে বলেছি যেই অপরাধ করুক ব্যবস্থা নিক তারা। আমরাও প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি,” বলছিলেন তিনি।
দলটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র বলছে, সারাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় গত বছর অগাস্ট থেকে শুরু করে চলতি মাস পর্যন্ত চার হাজারের বেশী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। এর মধ্যে ময়মনসিংহের একজন নেতার বিরুদ্ধে দল বাদী হয়ে মামলাও করেছে।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে গত বুধবার রাতে পাটগ্রাম থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে এক মাসের সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামিকে থানা থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা। পরে এ ঘটনা হওয়া মামলায় সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মচারীকে মারধর, সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও চুরি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় দুই জনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
রাতেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে র্যাবের সহযোগিতায় পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে কয়েকজন বিএনপির ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের পদধারী নেতা। আজ শনিবারও এই মামলায় তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ যারা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতা।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই ঘটনায় বিএনপির অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দল, যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন ওই নারীর স্বামী। এ ঘটনাতেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।
ওই একই এলাকায় ভিজিএফ চাল বণ্টন নিয়ে বিরোধ ও মহিলা দলের একজন নেত্রীকে মারধরের ঘটনায় দলীয় পদ হারিয়েছেন ভোলার তজুমদ্দিনের চাচড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হাওরাদার। এ ঘটনায় মহিলা দল নেত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকার মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকার হোটেল জাকারিয়া ইন্টারন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে একজন যুবদল নেতার অনুসারীদের হামলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ওই যুবদল নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এছাড়া সম্প্রতি চাঁদা দাবির অভিযোগ পাওয়ার পর রাজশাহী মহানগরের অধীন রাজপাড়া থানা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রবিউল আলমকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাতক্ষীরা পৌর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির ও পৌর বিএনপির সাবেক সদস্য মাসুম বিল্লাহ'কে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবু জাহিদ ডাবলু স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় কার্যালয়েই হামলা ভাংচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে।
নেতাকর্মীরা কি বেপরোয়া হয়ে উঠছে
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন বিএনপির বিশাল পরিমাণ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অল্প কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে এবং সে কারণে তারা মনে করেন ঢালাও ভাবে তাদের দলকে এজন্য দোষারোপের সুযোগ নেই।
“বিচ্ছিন্নভাবে অনেক ঘটনা ঘটে। আমাদের দলের কেউ জড়ালে আমরা খবর পেলেই ব্যবস্থা নেই। সরকারকেও বলেছি তারাও অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। আমরা সহযোগিতা করবো,” বলেছেন তিনি।
পাটগ্রাম ও ভোলার ঘটনা নিয়ে গত দুদিনে ব্যাপক সমালোচনার পর শুক্রবার দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, বিএনপির এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ৪-৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তারা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন।
“যারা দলের নামে, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নামে, সহযোগী সংগঠনের নামে দুর্বৃত্ত চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে অথবা দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তুলেছিল, অনৈতিক কাজের মধ্যে ছিল, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা চলমান থাকবে,” বলেছেন তিনি।
ওদিকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে প্রথম ছয় দিনেই সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় ৬৭ জনকে বহিষ্কার করেছিলো বিএনপি।
এরপর বিভিন্ন জায়গায় যখনই যা ঘটেছে সেগুলোর বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছিলেন লন্ডনে থাকা দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে অনুযায়ী দলের দপ্তর শাখা ব্যবস্থাও নিয়েছে।
দলের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিএনপি নেতাদের অটোমেটিক একটি কর্তৃত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে দলটির অনেক তখনই স্থানীয় পর্যায়ে হামলা, দখল কিংবা চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
তারা মনে করছেন আওয়ামী লীগের পতনের পর অনেকে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে নানা ঘটনায় জড়িয়েছেন, যা পরে দলের হাইকমান্ড নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে।
আবার পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর অনেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব স্থাপনে উদ্যোগী হওয়ার কারণেও নতুন করে কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে অপরাধমূলক ঘটনাগুলো নিতান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ বলেই মনে করেন তারা।
পরবর্তীতে এসব নিয়েই প্রায় সব জায়গাতেই দলের মধ্যেই গ্রুপিং ও কোন্দল বেড়েছে কিন্তু দলীয় নেতা তারেক রহমান দেশে না আসায় দলটির সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড ততটা কার্যকর হয়ে ওঠেনি।
“এ সুযোগেই অনেকে হয়তো ভাবছেন টাকা পয়সা অর্জন থেকে শুরু করে যা করার এখনি করে নেই। এটিও অনেকের অপরাধে জড়ানোর কারণ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিশ্লেষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান।
যদিও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “দলের ভেতরেও আমরা বলেছি কেউ অপরাধে জড়ালে আমরাও ব্যবস্থা নিবো, প্রয়োজনে আমরাই মামলা করবো, পুলিশের হাতে তুলে দিবো“।
তিনি অবশ্য বলেছেন, মুরাদনগরে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে অপপ্রচার চালালেও পরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীই ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। “অনেকে কিছু ঘটলেই বিএনপিকে জড়িয়ে অপপ্রচার শুরু করেন সুনাম ক্ষুণ্ণের জন্য,” বলছিলেন মি. আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোস্তফা আল মামুন বলছেন, বিএনপির মতো এমন বড় দলগুলোতে এটি একটি 'মজ্জাগত সংকট' যে তারা তাদের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলায় রাখতে পারে না।
“এটা সহজ কাজও নয়। কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের। সেটি নিশ্চিত হলে কোনো দলের নেতাকর্মীদের অপরাধে জড়ানো সহজ হতো না। এবার শুরু থেকেই বিএনপির অনেকে মাঠপর্যায়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব ও সুবিধা নিশ্চিত করতে নানা ঘটনায় জড়িয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে বিশ্লেষকরা এটিও বলছেন যে, এবার শুরু থেকেই বিভিন্ন পক্ষ যেখানেই যাই ঘটুক শুরুতেই বিএনপিকে জড়িয়ে একটি প্রচার শুরু করে।
“কিছু ক্ষেত্রে বিএনপির লোকজন জড়িত এটা যেমন ঠিক, তেমনি দলটিকে বিতর্কিত করার একটি চেষ্টাও অন্য দু একটি দলের নেতাদের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে,” বলছিলেন মোহাম্মদ মজিবুর রহমান।