
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খসড়া ভোটার তালিকা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করছেন মনোজ আগরওয়াল (মাঝখানে)। ছবি: সংগৃহীত
কলকাতা: ভারতের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনে প্রায় ৫৮ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। যে-সব রাজ্যে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন চলছিল, তার মধ্যে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ সহ পাঁচটি রাজ্যের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।
মঙ্গলবার দুপুর থেকেই নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে খসড়া তালিকা দেখা যাচ্ছিল, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা প্রকাশ করা হয় সন্ধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক মনোজ আগরওয়াল জানিয়েছেন, এই ৫৮ লক্ষ ভোটার হয় মৃত, অথবা পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত হয়েছেন বা এদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সংখ্যক ভোটার বাদে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে সাত কোটি আট লক্ষ ১৬ হাজার ৬৩১ জন।
তবে এর বাইরে আরও প্রায় দেড় কোটি ভোটার রয়েছেন, যাদের নাম খসড়া তালিকায় থাকলেও তাদের নিয়ে সন্দেহ আছে।
খসড়া তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের পৃথক একটি তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই তালিকায় নাম বাদ পড়ার কারণও উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ গেছে, তার মধ্যে ২৪ লক্ষের কিছু বেশি মানুষ মারা গেছেন, প্রায় ২০ লাখ ভোটার অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং ১২ লক্ষ ২০ হাজারের কিছু বেশি মানুষকে তাদের ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এর বাইরে এমন এক লক্ষ ৩৮ হাজার ভোটারের নামও মঙ্গলবার প্রকাশিত খসড়া তালিকা থেকে বাদ গেছে, যাদের নাম একাধিক কেন্দ্রে নথিভুক্ত ছিল।
নাম খুঁজতে ব্যস্ত মানুষ
মঙ্গলবার যে নিবিড় সংশোধন বা এসআইআরের পরে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে, তা অনেকদিন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এদিন সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নাম খসড়া তালিকায় আছে কি না, তা খুঁজতে শুরু করেন।
গোড়ায় কিছুটা বিভ্রান্তি ছিল যে ঠিক কোন লিংকে গেলে খসড়া তালিকা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে। দুপুরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর থেকে তাদের এক্স হ্যান্ডেলে সঠিক ওয়েবসাইট লিঙ্কটি দিয়ে দেওয়া হয়।
ওয়েবসাইটে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের ভোটার কার্ডের নম্বর দিয়ে অথবা মোবাইল নম্বর দিয়েও মানুষ খুঁজে নিতে পারছেন খসড়া তালিকায় নাম আছে কী না।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে ওয়েবসাইট ছাড়াও প্রতিটি বুথে ছাপানো খসড়া তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলিকেও তালিকার সফট কপি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
খসড়া তালিকা প্রকাশের পরেই শুরু হবে নিবিড় সংশোধনী বা এসআইআরের পরবর্তী পর্ব – যেখানে নির্বাচনী কর্মকর্তারা শুনানিতে ডাকবেন।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে খসড়া তালিকায় নাম না থাকলেই যে কোনও ব্যক্তি তার ভোটাধিকার হারাবেন, এমনটা নাও হতে পারে। যাদের নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ গেছে, তাদের নতুন করে একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আবার খসড়া তালিকায় নাম থাকলেই যে শুনানিতে ডাকা হবে না, এমনটাও নয়। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন যারা এসআইআরের ফর্ম পূরণ করেছেন, তাদের সবার নামই খসড়া তালিকায় আছে।
কিন্তু প্রায় ৩০ লাখ এমন নামও এই খসড়া তালিকায় আছে, যাদের নাম অথবা পরিবারের কারও নাম এর আগের এসআইআরে (২০০২ সালের) ছিল না। এদের শুনানিতে ডাকা হবেই।
আরও প্রায় দেড় কোটি এমন ভোটার আছেন, যাদের নাম খসড়া তালিকায় থাকলেও ডাকা হতে পারে শুনানিতে। চূড়ান্ত তালিকায় নাম ওঠার আগে শুনানিতে ডেকে তথ্য যাচাই করবে কমিশন।
ওই শুনানিতে হাজির হয়ে নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ১১টি নথির একটি জমা করতে হবে। সেই সব নথি খতিয়ে দেখে নির্বাচনী কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন যে ওই ব্যক্তি ভোটার কি না।
যাদের শুনানিতে ডাকা হবে, তাদের বাড়িতে নোটিশ পৌঁছিয়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। আগামী বছরের সাতই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুনানি চলবে।
আগে ঠিক করা হয়েছিল যে একেকজন নির্বাচনী কর্মকর্তা প্রতিদিন ৫০ জনের শুনানি শেষ করবেন। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক ভোটারের নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ যাওয়ায় এখন নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দিনে একশটি করে শুনানি করতে হবে।
এসআইআর নিয়ে রাজনীতি
ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনী শুরুর আগে থেকেই এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজা চলছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। বামপন্থী দলগুলিও এসআইআর প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছে।
মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেছেন যে একজন যোগ্য ভোটারকেও যদি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে তিনি দেশব্যাপী আন্দোলনে নামবেন। এসআইআর নিয়ে বারেবারেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং নির্বাচন কমিশনকে বিঁধেছেন তিনি।
অন্যদিকে, বিজেপি বলে আসছে যে এসআইআর সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে এক কোটিরও বেশি নাম বাদ যাবে – যারা, তাদের কথায়, বাংলাদেশ থেকে এসে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। এই ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ মমতা ব্যানার্জীর ভোট ব্যাংক বলেও অভিযোগ করে থাকে বিজেপি।
ঘটনাচক্রে, রাজ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে যে-সব বাংলাদেশের নাগরিক অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছিলেন, তাদের একটি অংশ নিজেদের দেশে ফিরে গেছেন বলে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটা কখনই বিজেপির দাবি – এক কোটির কাছাকাছিও নয়।
আবার বাংলাদেশ থেকে এসে অবৈধভাবে ভারতে যারা থেকে গেছেন, তাদের নাম যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নেই, এমনটাও বলা যাবে না। কিন্তু তাদের সংখ্যা ঠিক কত, তা বলা কঠিন।
পালাবদল/এসএ