
ঢাকা-৮ সংসদীয় আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। ফেসবুক পেজ থেকে
ঢাকা: ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে শহীদ মিনারে সর্বদলীয় প্রতিরোধ সমাবেশে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির কোনো নেতার যোগ না দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
সোমবার শহীদ মিনারে ওই সমাবেশের আয়োজন করেছিল ইনকিলাব মঞ্চ। ওই অনুষ্ঠানেই সংগঠনটির সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ জাবের জানিয়েছেন যে “বিএনপি সরাসরি উপস্থিত না হলেও জানিয়েছে, ইনকিলাব মঞ্চের সব আন্দোলনে সঙ্গে তারা একাত্মতা পোষণ করে।”
বিএনপির কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও ওই সভায় দেশে এ মুহূর্তে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামীসহ আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
শনিবারের এ সমাবেশে সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ‘একটা লাশ পড়লে আমরা কিন্তু লাশ নেব’ বক্তব্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। আলোচনা হচ্ছে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য নিয়েও। তিনি সেভেন সিস্টার্সকে (ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য) ভারত থেকে আলাদা করার হুমকি দিয়েছেন।
বিএনপির কয়েকজন নেতার সাথে যোগাযোগ করলেও তারা এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য শুধু বলেছেন, রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার হওয়া কিংবা উত্তেজনা বা উস্কানিতে যেন জড়াতে না হয় সেজন্যই সশরীরে ওই সভায় তারা যাননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দলটির সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস যেভাবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন সেটি সোমবারের সভায় সশরীরের দলটির নেতাদের না যেতে ভূমিকা রেখেছে বলে তারা মনে করেন। তারা এও বলছেন যে, অভিজ্ঞতা থেকে দলটির নেতারা হয়তো আঁচ করতে পারছিলেন যে বিভিন্ন ধরনের ‘বিতর্কিত’ কিংবা ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য আসতে পারে, যার দায় বিএনপি নিতে চায়নি।
শুক্রবার ঢাকার বিজয়নগরে নির্বাচনী প্রচারের সময় গুলিবিদ্ধ হওয়া শরিফ ওসমান হাদি এখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন আছেন।
তাকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে সোমবারের সভায় জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ সহ বিভিন্ন দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন। সোমবার সভায় সভাপতিত্ব করেছেন সাবেক খালেদা জিয়া সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ও বর্তমানে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। মাহমুদুর রহমানের বক্তৃতা বিবৃতিতে সবসময় ভারত বিরোধিতাই উপজীব্য বিষয় থাকে বলে অনেকে মনে করেন।
সোমবারের সভার বিষয়ে তার পত্রিকা আমার দেশ-এ বলা হয়েছে, “ইনকিলাব মঞ্চের আহবানে শুরু হওয়া ওই সমাবেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও জুলাই অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্মের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।”
অনুষ্ঠান চলাকালে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব বিএনপি নেতাদের কারও সেই সভায় না থাকার বিষয় সম্পর্কে জানান যে, দলটি তাদের কর্মসূচিতে একাত্মতা পোষণ করেছে। যদিও ওই সভায় বিএনপির অনুপস্থিতিকে ছাপিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন সাবেক তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও এনসিপির একজন নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ।
মাহফুজ আলম তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেছেন, “খুবই সংকটময় পরিস্থিতি সামনে। আমাদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। একটা লাশ পড়লে আমরা কিন্তু লাশ নেব। অত সুশীলতা করে লাভ নেই।”
তিনি আরও বলেন, “৫ই অগাস্টের পর যখন মুজিববাদীদের, আওয়ামী লীগ ও ১৪–দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রতিটি বাড়ি চুরমার করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, সেদিন আমরা নিজেদের সংবরণ করেছিলাম বলে আজকে তারা এই সাহস পাচ্ছে। আমরা ক্ষমা করে যদি ভুল করে থাকি, তাহলে আমরা প্রতিজ্ঞা নেব, আমরা আর ক্ষমা করব না।”
“ভারত থেকে আপনারা সন্ত্রাসের উসকানি দেবেন, সন্ত্রাস চালাবেন, আমার ভাইয়ের ওপর গুলি চালাবেন, এটা আমরা বরদাশত করব না,” বলেছেন তিনি।
ওই সভাতেই এনসিপির হাসনাত আব্দুল্লাহ তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেছেন, “ভারতের যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আছে বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে যেই সেভেন সিস্টার্স রয়েছে সেটাকে ভারত থেকে আলাদা করে দিবো।”
বিএনপি কেন যায়নি
ওই সভায় যোগ দিয়েছেন এমন কয়েকজন নিশ্চিত করেছেন যে, ইনকিলাব মঞ্চের দিক থেকে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তারাও সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেননি। যদিও দলটির কেউ শেষ পর্যন্ত আর সভায় যাননি। বরং শহীদ মিনারে ওই অনুষ্ঠান চলাকালে দলটির পক্ষ থেকে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাদের ফোন করে দলের পক্ষ থেকে সংহতি প্রকাশের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাহলো ওসমান হাদি আহত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর তাকে দেখতে গিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ওই দিনই চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “মির্জা আব্বাস রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সহানুভূতি জানাতে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই দলের কিছু ব্যক্তি, সমর্থক ও আরও কিছু চক্রান্তকারী সেখানে সমবেত হয়ে উত্তেজনাকর শ্লোগান দেয় এবং এক পর্যায়ে তারা মব সৃষ্টির চেষ্টা করে। যেটাকে তীব্র নিন্দা জানাই। এ ধরনের আচরণ করলে বিএনপি বসে থাকবে না। আমরা গোলযোগ চাই না। কিন্তু বিএনপির ওপর আঘাত আসলে কীভাবে জবাব দিতে হয় বিএনপি তা জানে,” বলেছিলেন তিনি।
এসময় তিনি উত্তেজনা না করতে এবং নির্বাচনের পরিবেশ যেন বিনষ্ট না হয় সেজন্য কাজ করতে সবার প্রতি আহবান জানান।
দলের নেতারা ধারণা দিচ্ছেন যে, ওসমান হাদি ইস্যুতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করে বিএনপি এবং সে কারণে সে ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ গরম হোক এবং সেটি নির্বাচনের পরিবেশে কোনো প্রভাব ফেলুক- তা বিএনপি নেতৃত্ব চান না।
পাশাপাশি, মির্জা আব্বাসের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তাতে শহীদ মিনারে দলটির নেতারা আবার নতুন করে ‘কোনো গোষ্ঠীর প্ররোচনায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়েন কি-না’ তা নিয়ে দলের ভেতরে উদ্বেগ ছিল। এছাড়াও অনুষ্ঠানের আয়োজক ও অন্য সম্ভাব্য বক্তাদের কাছ থেকে ‘বিতর্কিত ও উস্কানিমূলক বক্তব্য আসতে পারে'’- এমনটিও ধারণা করেছিলেন দলের সিনিয়র নেতারা।
এসব মিলিয়েই শেষ পর্যন্ত আর শহীদ মিনারের সভায় যাননি বিএনপির কেউ। তবে দলের পক্ষ থেকে ফোন করে সংহতির কথা জানিয়ে দেয়া হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, মির্জা আব্বাস ও বিএনপির দিকে ওসমান হাদির সহকর্মীদের কেউ কেউ যে আঙ্গুল তুলেছেন তা দলটি ভালোভাবে নেয়নি বলে মনে করেন তিনি।
“এছাড়াও আমার ধারণা বিএনপি কোনো অস্থির পরিস্থিতি চায় না, যা নির্বাচনকে হুমকিতে ফেলতে পারে। সেটি তাদের বক্তব্যেও এসেছে। এ কারণে রাজপথ গরম করার পক্ষপাতী নয় তারা। আমার ধারণা এসব কারণেই তাদের কেউ শহীদ মিনারে যায়নি,“ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলছেন, অভিজ্ঞতা থেকেই বিএনপি নেতারা হয়তো ধারণা করছিলো যে ওই সভায় কি ধরনের বক্তব্য আসতে পারে এবং সে কারণেই বিএনপি সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
“ওই সভায় যেসব বক্তব্য এসেছে তাতে এখন পরিষ্কার যে বিএনপি গেলে তাদের এসব বক্তব্যের দায় নিতে হতো। এ ধরণের উস্কানিমূলক বক্তব্য আসতে পারে ধারণা করেই হয়তো সরাসরি ওই সভায় যায়নি বিএনপি,” বলছিলেন মি. রহমান।
যদিও এর আগে ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নেতাদের ডেকে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই বৈঠকের আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আসা ওসমান হাদির পরিবারকে মি. ইউনূসের উপস্থিতিতেই একসাথে সান্ত্বনা দিতে দেখা গেছে বিএনপিসহ এসব দলের নেতাদের।
পালাবদল/এসএ