
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ছবি: সাক্ষাৎকারের ভিডিও থেকে নেওয়া
২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। লন্ডনে থাকলেও আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। সেই ভূমিকার জন্য গত এক বছরে কেউ কেউ তারেক রহমানকে এই আন্দোলনের ‘একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তারেক রহমান জানিয়েছেন, তিনি নিজেকে জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে দেখেন না।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বিবিসি বাংলাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের উত্তরে তারেক রহমান বলেছেন, “কোনো দল বা ব্যক্তি নন, জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।”
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে বিএনপির কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা তারেক রহমানকে এই আন্দোলনের ‘একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন। বিষয়টি উল্লেখ করে তারেক রহমানের কাছে বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল, তিনি নিজেকে এই আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে দেখেন কি না?
উত্তরে তারেক রহমান বলেছেন, “না, আমি অবশ্যই এই জুলাই আন্দোলনে আমাকে কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই আন্দোলন সফল হয়েছে জুলাই মাসে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু বহু বছর আগে থেকে। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে। আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে (২০২৪ সাল) এসে জনগণ সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে।”
শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নন, আরও নানা পর্যায়ের মানুষ জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা, তারা ছিলেন এই আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি, গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টসকর্মী-তারা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এই আন্দোলনে। এমন অনেক সাংবাদিক, যারা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না, খাটো করে দেখতে চাই না।”
তারেক রহমান বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন দৃঢ়ভাবে, সমাজের দল–মতনির্বিশেষে, শ্রেণিবিন্যাস–নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের এই আন্দোলনে অবদান আছে। এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তারা এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল, বিবিসি বাংলা এই প্রশ্ন করে। উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে। এবং সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার। আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এই যোগাযোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদের করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।’
জুলাই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের দাবি বা সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের যে চেষ্টা, সেখানে বিএনপির কোনো দায় আছে কি না, তা তারেক রহমানের কাছে জানতে চায় বিবিসি বাংলা। জবাবে তিনি বলেন, “দেখুন, ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই আন্দোলন, মানুষের এই আত্মত্যাগ, সাধারণত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিশু হত্যা হয় না, শিশু শহীদ হয় না, শিশু মৃত্যুবরণ করে না। কিন্তু আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনে...যতটুকু আমার মনে আছে, প্রায় ৬৩ জন শিশু শহীদ হয়েছে, মারা গিয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে, এই আন্দোলনের ক্রেডিট দল–মতনির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়। অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, ডিমান্ড করতে পারেন, সেটি তাদের অবস্থান।”
এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী, তা বলতে গিয়ে তারেক রহমান বলেন, “আমি বা আমার দলের অবস্থান হচ্ছে, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনে জনগণ সফলতা লাভ করেছেন। আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ আছে। একটি পক্ষ হচ্ছে মানুষ শহীদ হয়েছে। দুই হাজারের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনে। আবার আরেকটি পক্ষ হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজারের মতো মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। আমার মনে হয়, আমাদের উচিত হবে, এখন আমাদের সকলের উচিত হবে, রাষ্ট্রসহ, সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর যার যতটুকু সম্ভব, সেই পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যতটুকু সহযোগিতা তাদের করা যায়, যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো।”
বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাদির কল্লোল তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব আজ সোমবার সকালে প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। এর দৈর্ঘ্য ৪৪ মিনিটের বেশি। সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হবে আগামীকাল মঙ্গলবার।
পালাবদল/এসএ