
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফাইল ছবি
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, তিনি আসন্ন ১৩তম সংসদীয় নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে থাকবেন। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমনটি বলেন।
এটি প্রায় দুই দশকের মধ্যে তার প্রথম সাক্ষাৎকার। এতে তিনি নির্বাচন, রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকারে তারেক বলেন, “আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে যে প্রত্যাশিত নির্বাচন জনগণ চাইছে, সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে জনগণের সঙ্গে, জনগণের মাঝেই থাকব।”
তিনি বলেন, “কিছু সঙ্গত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে উঠেনি এখনো। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। দ্রুতই ফিরে আসব।”
বিএনপির এই নেতা প্রায় ১৮ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন। তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক। “কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকবো?“
৫৮ বছর বয়সী তারেক বলেন, বাংলাদেশে তার অনুপস্থিতি শুধুমাত্র শারীরিক। “ফিজিক্যালি হয়তো আমি এই দেশে (যুক্তরাজ্য) আছি, কিন্তু মন মানসিকতা, সবকিছু মিলিয়ে তো আমি গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছি।”
নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “জ্বি.. ইনশাআল্লাহ।”
গণমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কেন দীর্ঘ সময় কথা বলেননি, জানতে চাইলে তারেক রহমান বলেন, “ব্যাপারটা বোধহয় এরকম নয়, একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি এই দেশে, প্রবাস জীবনে। আমার ওপর যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে, তারপর থেকে আমি গ্রামে-গঞ্জে আমার নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ, সবার সঙ্গে কথা বলেছি।”
তিনি আরও বলেন, “আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় কোর্ট থেকে রীতিমতো একটি আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারত না।”
তারেক রহমান বলেন, “আমি কথা বলেছি, সামাজিক মাধ্যম সহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশাল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি তা, না। আমি কথা বলেছি, হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি, অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি আমি থেমে থাকিনি।”
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের নির্দেশ দেন। পরের দিন, হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ সরকারকে আদেশ দেন, দেশে না ফেরা পর্যন্ত তার বক্তব্য ছাপানো, ইলেকট্রনিক বা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত বছরের ২২ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর হাইকোর্ট সব ধরনের মিডিয়া ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
বিএনপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই নেতা কার্যত দলের নেতৃত্বই দিচ্ছেন। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর তার পরিবারের সঙ্গে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তিনি।
এক-এগারো বলে পরিচিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও কন্যা জায়মা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে যান।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়, অনুপস্থিত থাকায় তিনি পাঁচটি ভিন্ন মামলায় দণ্ডিত হন এবং তার বিরুদ্ধে প্রায় ১০০টি মামলা দায়ের করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে কোনো পেন্ডিং মামলা নেই।
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আপনার, আপনাদের বা বিএনপির অবস্থানটা কী জানতে চাইলে তারেক রহমান বলেন, “আমি ১৭ বছর যাবত প্রবাস জীবনে আছি। তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার ওপর হয়েছিল, তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি।”
তিনি বলেন, “আমি যখন এখানে আসি, আমার ছোট ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম। আমার সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যে ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি, যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল, যে ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যে ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল।”
“সেই স্মৃতিগুলোকে ভেঙে-চুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যে সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম, সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, উনার ওপরে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে,” বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি আরও বলেন, “আমি আমার পরিবারের যে কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এটিকে আপনারা কাহিনী বলুন, বা সংগ্রাম বলুন-যেটাই বলুন না কেন, এটি শুধু আমার কাহিনী না, বা আমার পরিবারের কাহিনী না। এ রকম কাহিনী বাংলাদেশের শত না, হাজার হাজার পরিবারের।”
“যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গেছে, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় জেলের ভেতরে মারা গেছে, সহায়-সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে-এই সব অন্যায়, এই সব হত্যা, এই সব নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হতে হবে।”
“এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়। এটি ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়,” যোগ করেন তিনি।
এখানে একটি বিষয় আলোচনায় এসেছে যে, যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা-না পারার প্রশ্নে বিএনপিরও অনেক নেতা অনেক সময় বলেছেন যে, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে তারা নন। এখন নির্বাচনও সামনে আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না সে ধরনের একটা প্রশ্নও আসছে। সেই জায়গায় বিএনপির অবস্থানটা কী হতে পারে-জানতে চাইলে তারেক রহমান বলেন, “দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে, তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে।”
আদালতের বিষয়টি মনে করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দল হিসেবে যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে তাই হবে। সোজা কথায় অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তি হোক, সেটি দলই হোক। যারা জুলুম করেছে, তাদের তো বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে। সেটি দলও হতে পারে।”
আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা উচিত কি না-প্রশ্নের জবাবে ব্যক্তিগত মত জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, আপনার কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য।”
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময় বলিও, আমরা বিএনপি যারা করি, আমাদের রাজনৈতিক সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই, যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থ-সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে, জনগণ তাদেরকে সমর্থন করতে পারে বলে আমি মনে করি না।”
“জনগণ যদি সমর্থন না করে, কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তের ওপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ,” যোগ করেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গ
এখন যে সক্রিয় দলগুলো আছে, তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে বিএনপির নেতাদের অনেক সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে মনোভাবটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টা হচ্ছে যে, দেখুন, বাংলাদেশের স্বীকৃত যে নিয়ম, আইন-কানুন আছে, এগুলোর ভেতরে থেকে যদি কেউ রাজনীতি করে, অবশ্যই করতে পারে। বিএনপি সব সময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কাজেই বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখতে চাই।
তিনি বলেন, দেশের যে আইন-কানুন আছে, তার ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।
জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির সঙ্গে এক সময় মিত্র ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সামনে আনছেন। কিন্তু বিএনপি আবার তাদের সাথে সরকারও গঠন করেছিল একটা সময়-এ ব্যাপারে তারেক রহমান বলেন, “২০২৪ সালে স্বৈরাচার যে হত্যাগুলো করেছে, দেশ স্বাধীনের পরে যখন তারা সরকার গঠন করেছিল, ক্ষমতায় ছিল, তখনো যে সকল লুট তারা করেছে, খুন-গুম তারা করেছে। বিগত ১৭ বছর গুম-খুন যারা করেছে, এর জবাব যে রকম তাদেরকেই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দেবেন। ওটা তো আর আমি দিতে পারবো না। আমারটা আমি দিতে পারবো। অন্যেরটা তো আমি দিতে পারবো না।”
পালাবদল/এসএ