গাজায় ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করা মানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গত ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫৮৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪,১৮৬ জনেরও বেশি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
অবরুদ্ধ গাজায় যখন দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া, তখন প্রতিদিনই ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে হত্যাযজ্ঞ চলছে। ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকাকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি সেনা বলেছেন, ত্রাণকেন্দ্রগুলো এখন ‘কিলিং ফিল্ড’ বা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।
আরেক ইসরায়েলি সেনা বলেন, ত্রাণের জন্য ভিড় করা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানো এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে তাদের ওপর সরকারি নির্দেশ ছিল।
তিনি বলেন, “আমরা ট্যাংক থেকে মেশিনগান চালিয়েছি, গ্রেনেড ছুড়েছি। একটি ঘটনায়, ত্রাণের আশায় এগিয়ে আসার একদল লোকের ওপর গুলি চালানো হয়।” আরেকজন সেনা জানান, তিনি গাজার যে এলাকায় অবস্থান করছেন, সেখানে প্রতিদিন এক থেকে পাঁচজন নিহত হন। তিনি বলেন, “এটা একটা মৃত্যু উপত্যকা।”
ত্রাণকেন্দ্রগুলো এত বিপজ্জনক কেন
গাজায় ত্রাণবিতরণে একমাত্র জিএইচএফ ছাড়া আর সব সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইসরায়েল।
গাজা সিটি থেকে আল জাজিরার হানি মাহমুদ জানান, খাবার পাওয়ার একমাত্র উৎস হলেও এই ত্রাণকেন্দ্রগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন গাজাবাসী। কারণ এখানে সাহায্যপ্রার্থীদের ওপর প্রায়ই গুলি চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। কিন্তু চাইলেও তারা ত্রাণকেন্দ্র থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারে না। খাবার না পাওয়ার অর্থ হলো ফিলিস্তিনি শিশুদের অনাহারে থাকা।
জাতিসংঘের তত্বাবধানে গাজায় প্রায় চারশ কেন্দ্র থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হতো। কিন্তু মার্কিন সংস্থার হয়ে কাজ করা সশস্ত্র বেসরকারি ঠিকাদারদের পাহারায় থাকা জিএইচএফ মাত্র চারটি ‘মেগা-সাইট’ থেকে এই কাজ চালাচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি দক্ষিণে এবং একটি মধ্য গাজায়। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি যেখানে, সেই উত্তর গাজায় কোনো ত্রাণকেন্দ্র নেই।
যে চারটি ত্রাণকেন্দ আছে সেগুলোও সব সময় খোলা থাকে না। কখনও কখনও মাত্র এক ঘণ্টার জন্য ত্রাণকেন্দ্র খোলা হয়। ফেসবুকে একটি ত্রাণকেন্দ্র থেকে খোলার ঘোষণা দেওয়ার মাত্র আট মিনিট পরই ত্রাণ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। এগুলো চলে ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে। ফলে প্রায়ই মরিয়া হয়ে ছুটতে দেখা যায় অনাহারীদেরকে।
এই ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানোও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে বহু কিলোমিটার হেঁটে বায়োমেট্রিক চেকপোস্টের ভেতর দিয়ে এসব জায়গায় পৌঁছাতে হয়।
ত্রাণের বাক্সে কী থাকে
একটা ত্রাণের বাক্সে যা থাকে, তা দিয়ে স্বাভাবিক জীবন ধারণ প্রায় অসম্ভব। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যেখানে প্রতিদিন জনপ্রতি ২১০০ ক্যালোরি গ্রহণের সুপারিশ করে, সেখানে ইসরায়েল একজনের জন্য মাত্র ১৬০০ ক্যালোরির সীমা বেঁধে দিয়েছে। এর অর্থ হলো গোলাগুলি উপেক্ষা করে কেউ নিয়মিত ত্রাণ পেলেও তাকে আধপেটা থাকতে হবে। তবে জিএইচএফ-এর পার্সেলে ১৭৫০ ক্যালোরির সমান খাবার থাকে। তবে এতে বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ, কম্বল বা রান্না করার কোনো জ্বালানি থাকে না।
আল জাজিরার সংবাদদাতা হিন্দ আল-খৌদারি গাজা থেকে জানিয়েছেন, জিএইচএফ-এর একটি বাক্সে চার কেজি ময়দা, কয়েক প্যাকেট পাস্তা, দুটি বিনের ক্যান, এক প্যাকেট টি-ব্যাগে এবং কয়েকটি বিস্কুট থাকে।
কোথা থেকে এলো গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন
যুদ্ধের আগে গাজায় প্রতিদিন প্রায় ৫০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশ করত। ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হলে তা দিনে ৮০টির নিচে নেমে আসে। গত মার্চে গাজায় সব ধরণের ত্রাণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে ইসরায়েল। প্রায় তিন মাস পর নিয়ন্ত্রিত উপায়ে গাজায় ত্রাণ দেওয়া শুরু হয়।
গত ২৭ মে থেকে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন বেসরকারি ঠিকাদার হিসেবে জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে নতুন বিতরণ ব্যবস্থা চালু করে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা এই সংস্থাকে ‘একটি ইসরায়েলি মস্তিষ্কপ্রসূত’ ধারণা বলে আখ্যা দিয়েছে। এই সংস্থা কোথা থেকে টাকা পায় তা স্পষ্ট নয়।
সতর্ক করে ইউনিসেফ বলেছে, গাজায় শিশুদের অপুষ্টি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শুধু মে মাসেই, ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ৫,১১৯ শিশুকে তীব্র অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে-যা এপ্রিলের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১৫০ শতাংশ বেশি।
ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আঞ্চলিক পরিচালক এডুয়ার্ড বেগবেদার বলেন, “অপুষ্টির প্রতিটি ঘটনাই প্রতিরোধযোগ্য। গাজার শিশুদের কাছে প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসাসেবা পৌঁছাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে মানুষের সিদ্ধান্তেই মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।”
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) রিপোর্টের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৯৩ শতাংশ বাসিন্দা অর্থাৎ ১৯ লাখ ৫০ হাজার মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছেন। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে প্রতি পাঁচজন ফিলিস্তিনির একজন এখন অনাহারের মুখোমুখি।