বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫ ১৩ চৈত্র ১৪৩১
বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫
 
বিদেশ
আমেরিকার স্বর্ণভান্ডারের মজুত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ, রহস্য সমাধানে দুর্ভেদ্য দুর্গে ঢুকবেন ইলন মাস্ক!





পালাবদল ডেস্ক
Saturday, 22 February, 2025
2:00 PM
 @palabadalnet

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সরকারি ভল্ট থেকে হাপিস টন টন সোনা? রহস্য সমাধানে দুর্ভেদ্য দুর্গে ঢুকবেন দুঃসাহসী ধনকুবের!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণভান্ডারের মজুত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সেখানকারই রাজনৈতিক নেতারা। ফলে ভল্টে সোনা পরিদর্শনে যেতে পারেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক।

সরকারি কোষাগারে ঠিক ভাবে গচ্ছিত আছে তো দেশের সোনা? ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতেই এই প্রশ্নে তোলপাড় আমেরিকা। জবাব পেতে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়েছেন ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক। সব কিছু ঠিক থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই ভল্ট খুলে স্বর্ণভান্ডারে উঁকি দেবেন তিনি। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি ওয়াশিংটন।

প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর এক্স, স্পেস এক্স এবং টেসলার প্রধান মাস্ককে গুরুদায়িত্ব দেন ট্রাম্প। সরকারি খরচ কমাতে ধনকুবের শিল্পপতিকে কর্মদক্ষতা বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডিওজ়িই) প্রধান করেছেন তিনি। ফলে মার্কিন স্বর্ণভান্ডারের কোষাগারে উঁকি দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে মাস্কের। সেই ক্ষমতাবলে তিনি অবিলম্বে ফোর্ট নক্সে পাড়ি দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

মাস্কের সরকারি স্বর্ণভান্ডার পরিদর্শনের পরিকল্পনার কথা প্রথমবার প্রকাশ্যে আনেন ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির সেনেটর র‌্যান্ড পল। পরে অবশ্য সমাজমাধ্যমে নিজেই এই নিয়ে মুখ খোলেন মাস্ক। সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ‘জিরোহেজ’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে টেসলা-কর্তাকে ট্যাগ করে লেখা হয়, “ইলন মাস্ক যদি একবার ফোর্ট নক্সের ভিতরটা দেখে নেন, তা হলে আপামর মার্কিন জনতা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। সেখানে ৪,৫৮০ টন সোনা মজুত থাকার কথা।”

১৯৭৪ সালে শেষ বার বাইরের কোনো ব্যক্তির পা পড়েছিল ফোর্ট নক্সে। মাস্ককে উল্লেখ করে দেওয়া পোস্টে সে কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী। লেখাটি চোখে পড়তেই পাল্টা জবাব দেন টেসলা-কর্তা। তিনি লিখেন, “নিশ্চয় মজুত থাকা সোনা ঠিক আছে কি না, তা প্রতি বছর পর্যালোচনা করা হয়?” এই প্রশ্নের উত্তরে ‘জিরোহেজ’ লিখেছেন, “সেটাই তো হওয়ার কথা। তাই নয় কি?”

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি স্বর্ণভান্ডারের পোশাকি নাম ‘ইউনাইটেড স্টেটস বুলিয়ান ডিপোজ়িটারি’। এটি ফোর্ট নক্স নামেও পরিচিত, যা প্রকৃতপক্ষে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। এর ভিতরে রয়েছে একটি ভল্ট। আর সেখানেই থরে থরে সাজানো রয়েছে সরকারি কোষাগারে জমা থাকা সোনা। ওই দুর্ভেদ্য দুর্গটি কেন্টাকি রাজ্যের মার্কিন সেনাছাউনি সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আমেরিকার ট্রেজ়ারি বিভাগের (ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজ়ারি) হাতে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ফোর্ট নক্সে মজুত করা সোনার আনুমানিক মূল্য ৪২ হাজার ৫০০ ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রতি আউন্স সোনার দর ৪২.২২ ডলার ধার্য করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হলুদ ধাতুর দাম অনেকটা বৃদ্ধি পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ফোর্ট নক্সে মজুত থাকার সোনার বাজারমূল্য নতুন করে মূল্যায়ন করেনি। মাস্ক সেই কাজে হাত দিতে পারেন বলে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।

১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি নির্মিত ফোর্ট নক্সে দীর্ঘ দিন আমজনতা তো বটেই, মার্কিন রাজনীতিকদের প্রবেশও এক রকম নিষিদ্ধ। ১৯৭৪ সালে ‘নো ভিজিটর’ নীতি থেকে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজ়ারি বিভাগ। সে বছর দুর্ভেদ্য দুর্গটিতে পা রাখেন একদল সাংবাদিক এবং মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর প্রতিনিধি দল। কারণ, ওই সময়ে ফোর্ট নক্সের ভল্ট থেকে সমস্ত সোনা সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

গুজবের জেরে মার্কিন জনতার সরকারের উপর থেকে বিশ্বাস প্রায় উবে গিয়েছিল। ফলে এক রকম বাধ্য হয়েই তৎকালীন ট্রেজ়ারি সচিব ফোর্ট নক্স পরিদর্শনের অনুমতি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজ়ভেল্ট অবশ্য স্বর্ণভান্ডারের ভিতরে পা রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর কোনো প্রেসি়ডেন্ট ওই ভল্ট খুলে তার ভিতরে প্রবেশের দুঃসাহস দেখাননি।

যুক্তরাষ্ট্রের টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ফোর্ট নক্স কোনো উৎপাদনকেন্দ্র নয়। অর্থাৎ সেখানে ডলার ছাপানো হয়, এ কথা ভাবলে ভুল হবে। সোনা ছাড়াও ওই দুর্ভেদ্য দুর্গে রাখা আছে বহু মূল্যবান সরকারি সম্পত্তি। ভল্টে থাকা হলুদ ধাতুর বিশুদ্ধতা পরীক্ষার জন্য এক বার সেখান থেকে খুব সামান্য পরিমাণ সোনা সরানো হয়েছিল। সেটুকু বাদ দিলে বহু বছর ধরেই ফোর্ট নক্সে মজুত সোনা অবিকৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

১৯৩৭ সালে কেন্টাকির দুর্ভেদ্য দুর্গে প্রথম বার সোনা নিয়ে যাওয়া হয়। এর ভিতরে থাকা ভল্টটি খোলার নিয়মকানুন সকলের জানা নেই। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মূল মার্কিন সংবিধান, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, কনফেডারেশনের প্রবন্ধ, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণ ও তার গেটিসবার্গ ভাষণের খসড়া এবং অধিকারের বিলকে ফোর্ট নক্সে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। লড়াই থামার এক বছর আগে ১৯৪৪ সালে সেগুলি আবার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

একটা সময়ে ফোর্ট নক্সে বিদেশের কিছু মূল্যবান সামগ্রীও গচ্ছিত ছিল। সেই তালিকায় রয়েছে হাঙ্গেরির রাজা সেন্ট স্টিফেনের মুকুট, তরবারি, রাজদণ্ড এবং ম্যাগমা কার্টা। ১৯৭৮ সালে সেগুলি অবশ্য ফিরিয়ে দেয় মার্কিন সরকার। এর জন্য কেন্টাকির দুর্ভেদ্য দুর্গটির ভল্ট খুলতে হয়েছিল।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় জেমস বন্ড সিরিজ়ের ক্রাইম থ্রিলার ‘গোল্ডফিঙ্গার’। সেই হলিউড ছায়াছবিটির কাহিনি এগিয়েছিল ফোর্ট নক্সকে কেন্দ্র করেই। চলচিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর সরকারের ঘরে মজুত থাকা সোনা এবং ওই ভল্টকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ তীব্র হয়ে ওঠে। ‘গোল্ডফিঙ্গার’-এ বন্ডের ভূমিকায় ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা শন কনেরি।

সম্প্রতি ফোর্ট নক্সে মজুত থাকা সোনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন টেক্সাস থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান দলের কংগ্রেস সদস্য রন পল। সম্পর্কে আবার তিনি সেনেটর র‌্যান্ডের বাবা। তিন বার প্রেসিডেন্ট পদে লড়েছেন তিনি। যদিও কোনো বারই শিকে ছেঁড়েনি।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, র‌্যান্ড আবার ফোর্ট নক্স যে কেন্টাকি রাজ্যে অবস্থিত, সেখানকার সেনেটর। ফলে তার বাবার তোলা সন্দেহের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ২০১১ সালে সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গকে পল বলেন, “জনগণকে বলা হচ্ছে, সমস্ত সোনা ঠিকঠাক মজুত রয়েছে। অথচ ভল্ট পরিদর্শন করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে কোনো তথ্যও প্রকাশ করা হচ্ছে না। ফলে সরকার কিছু লুকোতে চাইছে কি না, সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।” একই সুর শোনা গিয়েছে র‌্যান্ডের গলাতেও।

এই পরিস্থিতিতে বিবৃতি দিয়েছেন মার্কিন ট্রেজ়ারি বিভাগের ইনস্পেক্টর জেনারেল এরিক এম থরসন। তিনি বলছেন, “ফোর্ট নক্সে সবই ঠিক রয়েছে। এই নিয়ে অযথা গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি করার কোনো মানে নেই।” প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে তৎকালীন ট্রেজ়ারি সচিব স্টিভ মুচিন, কেন্টাকির গভর্নর ম্যাট বেভিন এবং কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল শেষ বার ওই ভল্ট পরিদর্শন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে মোট যে সোনা মজুত রয়েছে, তার অর্ধেকই আছে ফোর্ট নক্সে। এর নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে মিন্ট পুলিশের উপর। দুর্ভেদ্য দুর্গটি তৈরি করতে ১৯৩৬ সালে জমি হস্তান্তর করে আমেরিকার সেনাবাহিনী। প্রায় ১০ হাজার বর্গ ফুট এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ফোর্ট নক্স। এটির নির্মাণে ওই সময়ে খরচ হয়েছিল ৪.৫ লক্ষ ডলার।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমেরিকার সরকার অবশ্য নিউ ইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়াতে সোনা মজুত শুরু করেছিল। কিন্তু উপকূলবর্তী এলাকায় যে কোনো সময়ে হামলা চালাতে পারে শত্রু, এই আশঙ্কায় পরবর্তী কালে ফোর্ট নক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৩৫ সাল থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরব হয়েছিল মার্কিন ট্রেজ়ারি বিভাগ।

মজার বিষয় হল, ফোর্ট নক্সের ভল্ট তৈরি হওয়ার পর সেখানে সোনা নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ। সেই সময়ে ট্রেনে সোনা পরিবহণ করা হয়েছিল। হলুদ ধাতুর সুরক্ষায় বগিতে মোতায়েন থাকত মার্কিন সৈন্যদল। এ ছাড়া অশ্বারোহী বাহিনীর নিরাপত্তায় ফোর্ট নক্সে সোনা নিয়ে যাওয়ার কথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে সরকারি নথিতে।

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2024
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com