গাজার রাফায় একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি সেনার গুলিতে নিহতদের নামাজে জানাজা। ছবি: রয়টার্স
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ একটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় সহায়তাকারী করপোরেট সংস্থাগুলোর একটি তালিকা উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার জেনেভায় এই প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এতে ৪৮টি করপোরেট সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, গুগলের মূল সংস্থা অ্যালফাবেট এবং আমাজন। তদন্তের অংশ হিসেবে এক হাজারেরও বেশি করপোরেট সংস্থার একটি ডেটাবেসও তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইসরায়েলের দখলদারিত্ব অস্ত্র নির্মাতা এবং বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্য আদর্শ “টেস্টিং গ্রাউন্ডে“ পরিণত হয়েছে। এখানে কারও নজর নেই বললেই চলে এবং কোনো জবাবদিহিও করতে হয় না। অথচ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে অবাধে মুনাফা করছে।”
গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার দিকে ইঙ্গিত করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “কোম্পানিগুলো এখন আর শুধু দখলদারিত্বের সঙ্গে জড়িত নয়, তারা গণহত্যার অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠেছে।” গত বছর আলবানিজ তার মত দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে বলে বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়, “ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েই যাচ্ছে কারণ এটি অনেকের জন্য লাভজনক।”
যেসব অস্ত্র ও প্রযুক্তি কোম্পানির নাম এসেছে
ইসরায়েলের ব্যবহার করা এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে আটটি দেশের অন্তত ১,৬০০টি কোম্পানি যুক্ত আছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন। ইতালীয় নির্মাতা লিওনার্দো এসপিএ এবং জাপানের ফ্যানুক কর্পোরেশন অস্ত্র উৎপাদনের জন্য রোবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।
অন্যদিকে, প্রযুক্তি পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং ব্যবহারে সহায়তা করে ইসরায়েলের “বৈষম্যমূলক পারমিট ব্যবস্থা“কে চালু রেখেছে। মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট (গুগল) ও আমাজন তাদের ক্লাউড এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ইসরায়েলকে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে দেশটির ডেটা প্রসেসিং এবং নজরদারির ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি আইবিএম ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি জনসংখ্যা, অভিবাসন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় ডেটাবেস পরিচালনা করছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত আছে।
মার্কিন সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম প্যালান্টিয়ার টেকনোলজিস ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সংস্থা যুদ্ধের ময়দানে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ‘ল্যাভেন্ডার’, ‘গসপেল’ এবং “হোয়ার ইজ ড্যাডি’-র মতো এআই সিস্টেম ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তুর তালিকা তৈরিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়েছে, যা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের জন্য সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ করে।
এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাটারপিলার, সুইডেনের ভলভো গ্রুপ, লিওনার্দোর মালিকানাধীন রাডা ইলেক্ট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার এইচডি হুন্দাই। এই সংস্থাগুলো পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ধ্বংস এবং অবৈধ বসতি নির্মাণের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।
বাড়ি ভাড়া দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম বুকিং ডটকম এবং এয়ারবিএনবি ইসরায়েল-অধিকৃত অঞ্চলে বাড়ি এবং হোটেল কক্ষ ভাড়া দিতে সহায়তা করে অবৈধ বসতি স্থাপনকে উৎসাহিত করছে।
ইসরায়েলে বিদ্যুৎ উতপাদনের জন্য কয়লা সরবরাহ করে মার্কিন কোম্পানি ড্রুমন্ড এবং সুইজারল্যান্ডের গ্লেনকোর। এরা মূলত কলম্বিয়া থেকে কয়লা নিয়ে আসে।
কৃষি খাতে, চীনের ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইসরায়েলের বৃহত্তম খাদ্য সংস্থা তনুভার বড় অংশের মালিক। ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমি থেকে এই কোম্পানিটি লাভবান হয়। মেক্সিকোর অরবিয়া অ্যাডভান্স কর্পোরেশনের মালিকানাধীন সেচ প্রযুক্তি সরবরাহকারী নেটাফিম অধিকৃত পশ্চিম তীরে পানি উত্তোলনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।
প্রতিবেদনে মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকরক এবং ভ্যানগার্ড-কে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির মূল বিনিয়োগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্ল্যাকরক প্যালান্টিয়ার, মাইক্রোসফট, আমাজন, অ্যালফাবেট ও আইবিএম-এর দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং লকহিড মার্টিন ও ক্যাটারপিলারের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী।
ভ্যানগার্ড ক্যাটারপিলার, শেভরন ও প্যালান্টিয়ারের বৃহত্তম এবং লকহিড মার্টিন ও ইসরায়েলি অস্ত্র নির্মাতা এলবিট সিস্টেমসের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী।
কোম্পানিগুলোর আইনি দায় কতটা
আলবানিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর উত্তর হলো “হ্যাঁ“। কোনো করপোরেট সংস্থা প্রত্যক্ষ বা ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনেয়ার দায় এড়াতে পারে না। কোনো বেসরকারি সংস্থা যেন মানবাধিকার লংঘনে যুক্ত হতে না পারে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে, কোনো রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও কোম্পানিগুলোকে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদেরকে আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা যেতে পারে।