“নাম ডেকে ডেকে তখন একজন করে ছেলেমেয়েদের ঢোকানো হচ্ছিল জেলখানার ভেতরে। নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। এক সময় বিরক্তির সঙ্গে বললেন, উহ্, অত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়? জেলখানা তো এমনি ভর্তি হয়ে আছে। ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠল, জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না। আর একজন বলল, এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।”
১৯৫২ সালের ৩ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য গ্রেফতার হন। সেই সময়ে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। বারবার তাকে আটক করা হয়েছে নানা অভিযোগে-বোঝাই যায় তিনি পাকিস্তানি শাসকের চোখে খুব বিপজ্জনক লোক ছিলেন। গ্রেফতার হতে হতে এবং ক্রমান্বয়ে ছাড়া পেতে পেতে অবশেষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সম্ভবত নিহত হন তিনি। সম্ভবত লিখছি এই কারণে যে, তার মৃতদেহ-মানে লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরো আশ্চর্যের কথা, তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে বাংলাদেশের আর এক বামপন্থী শিল্পী-লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান কায়সারের ভাই-তিনিও সম্ভবত খুন হয়ে যান পাকিস্তানি দালাল দাঙ্গাবাজদের হাতে। এখানেও সম্ভবত লিখতে হচ্ছে বাধ্যত। কারণ তার লাশও মেলেনি কোথাও। এই লেখার গোড়ায় যে অংশটি উদ্ধৃত করেছি, সেটি এই জহির রায়হানের লেখা উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ থেকে নেওয়া।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদ বন্ধুদের স্মরণ করতে গিয়ে ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের রক্তাক্ত আন্দোলনের কথাই এসেছিল রায়হানের উপন্যাসে। মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে যারা খতম হয়ে গেছিল, সেইসব বন্ধু-সেনানীকে স্মরণ করতে চাইছিল তারা। আর রাষ্ট্র বলছিল, স্মরণ করতে দেওয়া যাবে না, শহীদের স্মারক ভেঙে দেওয়া হবে। ভাষার অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে যে জুড়ে আছে মনে রাখার, স্মৃতির অধিকারটিও তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আমার প্রিয় স্মারক ভেঙে দিচ্ছে কেউ, আমার শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার চিহ্নটিকে সরিয়ে দিচ্ছে কেউ-এ দৃশ্যে নিশ্চয় আমাদের ক্রোধ হবে। কিন্তু এ শুধু আহত অস্মিতার প্রশ্ন নয়, অহঙ্কারে আঘাত লাগায় ক্রুদ্ধ চিৎকার নয়। বোঝা দরকার, স্মারক সরিয়ে দেওয়ার অর্থ আমার স্মরণ প্রক্রিয়াটিকেই আসলে লোপাট করার চক্রান্ত চলছে। কোনো স্মারকচিহ্নকে দেখে যেভাবে আমি মনে ‘রাখতে’ চাই অতীত, যেভাবে আমি সেই বিশেষ অতীতের ভিতে দাঁড় করিয়ে রাখি নিজেকে, শাসকের তা অপছন্দ বলে সেই ভিতটিকেই হাপিশ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে, বাহান্ন সালে ঢাকায় যে আক্রমণ হয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের উপর, তা আসলে ওই একদিনেই ফুরিয়ে যায়নি। পরে বারবার সেই লড়াইয়ের স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল। কে না জানে, তেমন তেমন সময়ে বিদ্রোহের ইতিহাসটুকু কেবল মনে রাখাও একটি বৈপ্লবিক কাজ। কেবল স্মরণে রাখা-হত্যার ঘটনা ও দৃশ্যাবলি ফিরে ফিরে দেখা, এই কথাটুকু ভুলে না যাওয়া যে, বারবার শাসক আমাদের ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে বন্ধুদের নাম, সহযোদ্ধাদের রক্ত শুকিয়ে খয়েরি হয়ে যাওয়া জামা। আর এও মনে রাখা, সালাম রফিক জাব্বার-এঁরা কেবল নামমাত্র নয়, ততোধিক কিছু, এরা চিহ্ন, নিরন্তর বাজতে থাকা চেতাবনিও বটে। এঁরা কেবল ভাষাপ্রেমিক ছিলেন এই ভুল যেন না করি কখনো, এঁরা স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ লড়াইয়ের শহীদ। যতই মধুর ও ললিত হোক না কেন, মাতৃভাষার বদলে অন্য ভাষায় কথা ও কাজ চালাতে বাধ্য করা মানে সত্তার সবটুকু কেড়ে নেওয়া--এ তারা নিশ্চয় বুঝেছিলেন। আর এও বুঝেছিলেন, চেতনার দাসত্বের মতো আঁধার পরাধীনতা আর কোথাও নেই। তখন পরাধীনেরও আর নিজেকে তত পরাধীন মনে হয় না। শিকলকেও মনে হতে থাকে অলঙ্কার।
তাই ‘মনে রাখবই’-এ কথাটি এক স্পর্ধিত স্লোগান। বিশ্বখ্যাত গানের করুণ সুরে যে বারবার ধুয়ার মতো ফিরে আসেই ওই কথাগুলি-‘আমি কি ভুলিতে পারি?’-মানে কী তার? এ কোনো জিজ্ঞাসা নয়, শোকজ্ঞাপনও নয়। এ আসলে ঘোষণা, এই কথাটি জানিয়ে দেওয়া যে, ‘ভুলব না’। কেননা ভুলে গেলেই ওই ‘আমি’ টিও হারিয়ে যাবে, মুছে যাবে। পরিচিতিহীন হয়ে যাবে। তাই, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতেই হয়। কারণ ওইটে আত্মরক্ষার সংগ্রাম, স-পরিচয় বেঁচে থাকার লড়াই। হাল আমলে ২১ ফেব্রুয়ারি অনেক সময় হয়তো নাচে-গানে-বিনোদনে ভরপুর ভাষাদিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, খানিক আচারের মতো। কিন্তু এ তো কেবল ভাষারক্ষার কথা নয়, ‘মাতৃভাষা’ রক্ষার এবং সেই সূত্রে চিন্তার স্বাধীন প্রকাশের, একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের নিজ সংস্কৃতিতে সসম্মান থিতু থাকতে পারার অধিকার রক্ষার কথা। তাই এই স্মরণ প্রক্রিয়া, এই অনুষ্ঠান একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
২.
জার্মান আইডিওলজি বইতে মার্কস এবং এঙ্গেলস মানুষের ভাষা বিষয়ে একটি চমকপ্রদ কথা লিখেছিলেন। “মানুষের ভাষা চৈতন্যের (consciousness)সমান বয়সি...চৈতন্যের মতোই ভাষাও তৈরি হয় প্রয়োজন ও গরজ অনুযায়ী, অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও আদানপ্রদানের ভিত্তিতে।” আপাত দৃষ্টিতে এই কথার প্রথমাংশের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না, কেননা অনেকেই হয়তো বলবেন, চৈতন্য ভাষাসৃষ্টির পূর্বশর্ত। চৈতন্যযুক্ত সমস্ত জীবেরই ভাষা আছে তাও বলা যাবে না। যদি অনুমতি করেন, তাহলে মার্কসের ওই কথাটির একটি বিকল্প অর্থ আমরা প্রস্তাব করতে পারি-মার্কস এখানে চৈতন্য বলতে সাধারণ প্রাণময়তার কথা কিংবা যে কোনো অনুভূতি টের পাওয়ার কথা বলছেন না আদৌ, বরং তিনি ইঙ্গিত করছেন, আত্মচৈতন্যের কথা। যখন তার আমি-চেতনা ঘটে, সে বোঝে এইটে হলাম ‘আমি’ এবং ফলত, ওইটে হলো ‘অপর’- এই গোটা ঘটনাটি ভাষা ব্যতিরেকে ঘটাই সম্ভব নয়। অর্থাৎ, মানুষের আত্মচেতনা, তার আমি-বোধ উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে সে পৃথিবীর ও অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বিচিত্র সম্পর্কে প্রবেশ করে সে। তাকে কিছু খবর জানতে হয়, জানাতে হয় এবং মাঝে মাঝে খবরদারিও সে করে। এসবই ঘটে ভাষার মাধ্যমেই। হাতের পরিশ্রমে যখন কোনো জিনিস সে তৈরি করে, তখন, সেই একই প্রক্রিয়ায়, তার হাতটিও ক্রমশ ‘তৈরি’ হয়ে উঠতে থাকে। একই ভাবে মানুষের ভাষা ও ভাষার ব্যবহার তার চৈতন্যের কাঠামোও গড়ে পিঠে নেয়। মানুষ যেমন ভাষা সৃষ্টিকর্তা, তেমনি ভাষাও মানুষের চেতনার নির্মাতা বইকি।
চৈতন্য বলতে ঠিক কী বুঝব আমরা-তা নিয়ে বিস্তারিত তাত্ত্বিক তর্কাতর্কি আছে সবাই জানেন-সেদিকে আপাতত না গিয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের উক্ত কথাটির নিহিত উদ্দেশ্য এভাবেও হাজির করা যায়-মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা, নিজেকে ‘আমি’ হিসাবে চিনে নেবার ক্ষমতা যখন থেকে এসেছে তখন থেকেই তার ভাষাও এসেছে নিশ্চিত। ভাষাই মানুষের সেই শক্তির উৎস যা দিয়ে সে চিন্তা করে, নিজের বোধ ও জ্ঞানকে বিচার করে-কেবল শারীরিক অনুভূতির স্তর পেরিয়ে বিশ্লেষণযোগ্য জ্ঞানের জগতে পা রাখে। সোজা কথায়, যখন থেকে সে নিজেকেই নিজে জানিয়েছে-‘এই যে, আমি জানলুম’-তখন থেকেই ভাষা দরকার হয়েছে তার। ভাষা ছাড়া এমনকি নিজেকেও সে কিছুই জানাতে পারেনি। অন্তরের ভাবকেই কেবল ভাষা দিতে হয়-তা নয়, ভাষার কাঠামো ছাড়া ভাবটিও তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, কেবল একটি জান্তব অনুভূতি হয়েই থেকে যায়। ভাষাই ফলত মানুষের যাবৎ চিন্তাজগতের মূল খুঁটি।
এই দুটি খটোমটো অনুচ্ছেদের শেষে আমরা আসলে পৌঁছাতে চাই এই সিদ্ধান্তে যে, ভাষার স্বাভাবিক চালচলন, স্বাধীনভাবে ভাষা ব্যবহারের সুযোগ যদি বিঘ্নিত হয়, তাহলে মানুষের চৈতন্যেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য। একটি ভাষা-সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষের কাছ থেকে যদি কেড়ে নেওয়া হয় তার ভাষাটিকে, তাকে বাধ্য করা হয়, ভিন্ন কোনো অপরিচিত ভাষায় ‘যোগাযোগ’ চালাতে, তাহলে তার সমগ্র চৈতন্যই কুঁকড়ে থাকবে, তার স্বাধীনতা খর্ব হবে, তাকে ভিতর থেকে পরাধীন করে দেওয়া যাবে, তাকে ক্রমশ এমন এক বন্দিত্বে আটকে রাখা যাবে যাতে তার সমস্ত চিন্তাপ্রক্রিয়াকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পৃথিবীর নানা দেশে পুরাতন ও নব্য কলোনিওয়ালারা বারবার এই কাজ করেছে। পৃথিবীর বহু দেশে, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়ার নানা জায়গার মানুষের আদত ভাষা কেড়ে উপনিবেশ তার নিজের ভাষারাজ কায়েম করেছিল, ভিতর থেকে কেড়ে নিয়েছিল স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা। একই ঘটনা ঘটতে পারত পূর্ব পাকিস্তানে, যদি বাংলার বদলে উর্দু এসে চেপে বসত ঘাড়ে। উর্দুর স্বাভাবিক সৌন্দর্য তখন হয়ে পড়ত গৌণ, সেও হয়ে উঠত চেতনায় দাসত্ব কায়েমের হাতিয়ার। পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি সেই স্বাধীনতা হরণ প্রক্রিয়া রুখে দিয়েছিল বাহান্নতে, সূচনা করেছিল একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাধীনতা যুদ্ধ।
৩.
কিন্তু সব সময় কি এমনই চোখে আঙুল দেওয়া পদ্ধতিতেই ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়? সরাসরি রক্তপাত না-ঘটিয়ে, সরাসরি শিকল না পরিয়ে, এমনকি সরাসরি আগের ভাষা বাতিল না করেও ভাষার চরিত্র বদলে দেওয়া যায় বৈকি। গা-জোয়ারি করে ভাষায় যদি গুঁজে দিই বিশেষ শব্দাবলি? ভাষা কি শক্তিশালী হয় তাতে? না প্রতিবাদ করে? রেগে ওঠে? বেঁকে যেতে থাকে তার শরীর? আসলে তখন ভাষা ব্যবহারকারীর চৈতন্যে ছায়া ঘনায়। সেই ছায়া আঁধারে আঁধারে গড়তে থাকে মনোভূমি। মনোভূমি কোনো নির্দিষ্ট স্থানু পরিসর নয়, নয় ঈশ্বরের কোনো অনুদান। গড়ে ওঠা মন দিয়ে আমরা ভাষা শিখি, শেখা-ভাষা আবার সেই মনের উপর হাত রাখে, মনের শুশ্রূষা করে, তাকে ভোলায়, ভাবায়, উদ্দীপ্ত ও প্রসারিত করে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ভাষাই যে আমাদের চৈতন্য গড়েপিঠে নেবার মূল হাতিয়ার। ফলে ভাষা দখল মানে চেতনার দখলদারিকে নিশ্চিত করা।
আমাদের চারপাশে হিন্দির দীর্ঘমেয়াদি লম্ফঝম্ফ সকলেই লক্ষ্য করছেন। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দিকে পরিচিত করানোর নানা উদ্যোগ, রাস্তাঘাটে নিত্য টাঙানো ঝলমলে হোর্ডিং কিংবা বাংলা খবর কাগজে ছাপা বহু বিজ্ঞাপনে হিন্দিভাষার অসহ্য অনুবাদ-এসবই আমারা সয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়েছি। কতকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই বিভিন্ন এফ এম রেডিও চ্যানেলে ঘোষক ও সঞ্চালকেরা এক আশ্চর্য বাংলা বয়ান চালিয়ে যাচ্ছেন-হিন্দি ইংরেজির নানা শব্দ ও বাক্ভঙ্গি প্রতিদিন আছড়ে পড়ে কানে। বাংলাভাষী শ্রোতারা মাঝে মধ্যে ঈষৎ আহা-ইশ্ উচ্চারণ করে বা ন-করে সেসব গ্রহণও করেন। ধীরে ধীরে সেই সব কথার ধরন আমাদের দৈনন্দিন ব্যাবহারের ভাষার ‘স্বাভাবিক’ আদল হয়ে উঠতে থাকে। আমরা খেয়াল করি না, এই বদলাতে থাকা ভাষা, আমাদের চিন্তার ধরনকেও পালটে দিচ্ছে ভিতর থেকে।
কখনো আবার এক ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার কাল্পনিক যুদ্ধ লাগিয়ে, দুই ধর্মের মানুষের মধ্যেকার রেষারেষি ও ঘৃণা ভাষার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, কিংবা সরাসরি ‘হিন্দি হলো হিন্দুর আর উর্দু মুসলমানের’-এমন একটি মনোভাব দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার করে ভাষাগোষ্ঠীকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হয়। অনেকেই নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, এই হিন্দি-উর্দু ভাবনাটিকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে হিন্দির এক বিকৃত এবং আড়ষ্ট রূপ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে গোঁয়ারের মতো। হিন্দি ভাষায় ভুলেও যেন এক-আধটাও উর্দু শব্দ না ব্যবহৃত হয়-সংস্কৃত-বহুল, এবং উর্দু-বর্জিত কথন-অভ্যাস চলছে আমাদের দেশের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির সদরে অন্দরে। কেননা হিন্দি থেকে বিদেশি মুসলমানী ভাষার সব সংশ্রব হটাতে হবে।
ভাষার এই বিশেষ কৃত্রিম রূপ ভাষার পক্ষে ক্ষতিকারক তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় একটি ক্ষতি হচ্ছে, হয়েই চলেছে। ক্রমান্বয়ে এই ভাষার ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হলে ভাষা ব্যবহারকারীর চৈতন্যের একটি বিশেষ ধাঁচ গড়ে উঠবে অচিরেই। ব্যবহারকারী অজান্তেই একটি বিশেষ মনোভাব বহন করতে থাকবেন, সেই মনোভাব অনুযায়ীই তার যাবতীয় রুচি স্থির হতে থাকবে, নির্ধারিত হবে পছন্দসমূহ। ভাষার ধর্মপরিচয় অন্যায্য এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে করেছি আমরা দীর্ঘকাল, যার ফলে মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও গুলজার উর্দু সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারেন, হিন্দু হয়েও ফিরাক গোরখপুরি হতে পারেন অন্যতম সেরা উর্দু গজল রচয়িতা-কিন্তু আদিত্যনাথের দুনিয়ায় সেই চৈতন্য বদলে যাবে ক্রমশ।
আবার বলছি, এতে কেবল ভাষার ক্ষতি কিংবা লাভ মাপছি না, ভাবছি সেই বদলে যাওয়া চৈতন্য আসলে চারপাশের দুনিয়াটিকেই দেখতে থাকবে নতুন চোখে। আজকের হিন্দি ভাষায় বহু পুরাতন পানি শব্দটি হটিয়ে অপেক্ষাকৃত ‘হিন্দু’ শব্দ ‘জল’ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে-কেননা কোনো এক অজ্ঞাত প্ররোচনায় সিদ্ধ হয়ে গেছে ‘পানি’ মুসলমানের শব্দ, অতএব পরিত্যাজ্য। আমাদের বাংলা ভাষায় জল-পানি কেন্দ্রিক এই কুসংস্কার আছে অনেকদিন। সেই কুসংস্কার কাটাতে বহুবার বলেছি আমরা অতীতে, ওই যে দ্যাখো, হিন্দি ভাষার দিকে তাকাও... ওখানে কিন্তু হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে জল না বলে পানিই বলা হয়। আক্ষেপের কথা এই যে, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সামনে হিন্দির এই উদাহরণটি আর থাকবে না। হিন্দি ভাষাতেও মানা হবে জল হিন্দুর, পানি মুসলমানের।
একই জিনিস আমাদের পাশের দেশেও ঘটছে কিন্তু। ভাষায় মুসলমান-চিহ্ন গায়ের জোরে গুঁজে দিতেই হবে-এমন দুর্মর বাসনায় সহি আরবি শব্দের প্রচলন বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। এমনকি খাঁটি মুসলমানত্বের লোভে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে চলা বেশ কিছু ফারসি শব্দকেও হটিয়ে দিয়ে আমদানি করা হচ্ছে আরবি প্রতিশব্দ। নামাজ বলা যাবে না, ওটা ফারসি, অতএব সহি নয়। বলতে হবে ‘সালাত’। ‘খুদা’ শব্দটি ফারসি, তাই হটাও, বলো ‘আল্লাহ’, ওটা আসল। ভাষায় এই সংস্কার অভিযান যখন অনেকে মিলে করতে থাকেন তখন বোঝা যায়, অসুখ বহু দূর গড়িয়েছে-আমার চেতনার অধিকার আর আমার হাতে নেই। পুতুলের মতো আমি নেচে চলেছি। ভাষা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ হলো ভাষা গুলিয়ে দেওয়া। এবং সেই গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পরাধীনতার বোধও লুপ্ত হয়ে যায়-আমি খুশি মনে ভাবতে থাকি এই তো বেশ, এতে আর বন্দিত্ব কই?
৪.
আজ অন্তত, একটা সিদ্ধান্ত নিই আমরা। বাংলাভাষার জন্য যে সৎ আবেগ থাকার কথা মানুষের, তা না দেখতে পেলেই নিতান্ত উজবুকের মতো ‘বাঙালি জাতটাই ওইরকম’ কিংবা ‘বাঙালি বরাবরই এক আত্মবিস্মৃত জাত’ বলে সব দোষ ডিএনএ’র ভেবে পাশ কাটাবো না। ভাষা দখলের উদ্দেশ্যে বাইরে থেকে যে আক্রমণ আসছে তা রুখে দেওয়ার পাশাপাশি ভিতরের ত্রুটি সামলাতে যদি না পারি, মেনে নেওয়া ভালো একুশের উত্তরাধিকার বহন করার কোনো যোগ্যতাই তাহলে নেই আমাদের। মেনে নেওয়া ভালো, জহির রায়হানের উপন্যাসের চরিত্ররা যতই বলুক, আরো অনেক লোক আসছে পিছনে, আপনাদের জেলখানায় আঁটবে না, যতই বলুক আরেক ফাল্গুন অপেক্ষারত, আমরা সবাই জানি মনে মনে, ওসব কথার কথা। ভারতে বাংলা ভাষার বসন্ত কাল ফুরিয়ে গেছে।