
ফাইল ছবি
বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কারসহ ৪৮ দফা প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তা বিএনপিকে কিছুটা বিপাকে ফেলে দিয়েছে কি-না সেই প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।
কারণ ওই সুপারিশমালাকে দল ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা আখ্যায়িত করলেও, এর বিরুদ্ধে দলটি শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারছেনা নির্বাচন যেন ঘোষিত সময়েই হতে পারে সেই বিষয়টি চিন্তা করে।
এমনকি তারা এসব সুপারিশ গ্রহণ না করা বা প্রত্যাখ্যান করছে- এমন কোনো ঘোষণাও দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের ধারণা ‘সংস্কার বিরোধী তকমা’ যেন না লাগে সেজন্যই এমন অবস্থান নিয়েছে দলটি।
তবে বিএনপির ভেতরে অনেকেই মনে করেন, বিএনপি এই মুহূর্তে শক্ত কোনো অবস্থান নিলে সেটিকে কোনো কোনো গোষ্ঠী নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কারণ তাদের মতে, সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যাতে বিলম্বিত করানো যায় সেজন্য সক্রিয় আছেন।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে যা-ই হোক, পনের ফেব্রুয়ারির আগেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অবশ্য বলছেন, ঐকমত্য কমিশন যা করেছে তা বিএনপিকে নয়, পুরো জাতিকেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তার মতে, সরকারের উচিত কমিশনের সুপারিশে সংশোধনী এনে এর ফয়সালা করা।
কিন্তু সরকার বা কমিশনের এ কৌশলে বিএনপি চাপে পড়েছে কি-না কিংবা রাজনৈতিকভাবে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে কি-না সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
তবে বিএনপির সমমনা রাজনৈতিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলছেন, কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তি ও রাজনৈতিক দুশ্চিন্তা আছে যে কাদের জন্য এটা করা হলো।
“তবে এটা তো সুপারিশ। সিদ্ধান্ত নিবে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত দেখার পর বিএনপিসহ আমরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কেউ কেউ বলছেন, এতে বিএনপির বেকায়দায় বা বিপাকে পড়ার কিছু নেই কারণ জুলাই সনদের বিষয়ে দলটি তার অবস্থান আগেই পরিষ্কার করেছে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, বিএনপিকে চাপে রেখে বা কিছুটা বেকায়দায় ফেলে কেউ কেউ তাদের নিজস্ব দলীয় লক্ষ্য পূরণ করতে চাইছেন বলেই মনে করছেন তারা।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের জন্য তাদের সুপারিশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল।
বিএনপির অভিযোগ, তাদের সাথে কমিশনের আলোচনা বা ঐকমত্য যেসব বিষয়ে হয়েছে তা এসব সুপারিশে যথাযথভাবে আসেনি।
বিএনপির অবস্থান ও কৌশল
বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে এখন সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। আবার জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কিছু দল নির্বাচনের আগে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যদিও তারাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
এমন পরিস্থিতি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দিয়েছে তাতে কয়েকটি বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
দলটির নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাদের সাথে আলোচনা হয়নি এমন কিছু বিষয় সুপারিশে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের দেওয়া আপত্তিগুলোও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়নি।
আবার সুপারিশে গণভোটের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কোনো কোনো দল সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট চাইছে। কিন্তু বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক।
কমিশনের সুপারিশের সমালোচনা করে ঢাকায় গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, কমিশনের প্রস্তাব ও সুপারিশ একপেশে এবং জবরদস্তিমূলকভাবে তা জাতির ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
“এটাই প্রতীয়মান হয় যে দীর্ঘ প্রায় এক বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন। অর্থ ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা,” বলেছেন তিনি।
কিন্তু মির্জা ফখরুল তার ওই সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশমালাটি প্রত্যাখ্যানও করেননি। কিংবা এটি প্রত্যাহারের কোনো শর্তও সরকারকে দেননি।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন অবশ্য জানিয়েছেন, তারা মনে করেন সরকারের নিজেরই উচিত বিতর্কিত বিষয়গুলো সংশোধন করা।
বেকায়দায় পড়ার প্রসঙ্গ কেন
সরকার বা বিএনপির অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তাতে অনেকেই বলছেন যে, সংসদ নির্বাচনকে যে কোনো মূল্যে সফলের জন্যই দলটিকে কৌশলে এগুতে হচ্ছে। কারণ দলটির এ মুহূর্তে একমাত্র অগ্রাধিকার হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
যদিও দলটি আগেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। তখনো দলটি বলেছিলো যে, তাদের কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, যা এই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশে উল্লেখ থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো সুপারিশমালায় রাখেনি ঐকমত্য কমিশন, যা বিএনপিকে ক্ষুব্ধ করলেও দলটি আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান চাইছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির এমন অবস্থানের মূল কারণ হলো তারা নিজেদের সংস্কার বিরোধী হিসেবেও তুলে ধরতে চাইছে না।
তাছাড়া বিএনপি পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখালে তার জের ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে নির্বাচন বিলম্বিত হবার আশংকাও দেখা দিতে পারে- এ বিষয়টিও দলটির নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আছে।
“বিএনপির সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণাই হয়েছে। তারা শকড হয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে এটি নিয়ে টাফলাইনে গেলে নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এটা দলটির নেতাদের না বোঝার কারণ নেই। আবার আমার মনে হয় এগুলো ইচ্ছে করেই করা হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনী প্রস্তুতির বদলে এসব বিষয়ে ব্যস্ত রাখার জন্য,” বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদ।
যদিও কেউ কেউ আবার মনে করেন, বিএনপি এ মুহূর্তের বৃহত্তম দল হওয়ায় দলটিকে এক ধরনের চাপে রাখার জন্য সরকার বা সরকার ঘনিষ্ঠরা নানা কৌশল নিচ্ছে এবং কমিশনের সুপারিশমালা তারই একটি অংশ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
পালাবদল/এসএ