সুখের জন্য বন্ধু, পরিবার এবং সামাজিক বন্ধন থাকাটা জরুরি। তবে মানুষ কোন পরিবেশে বসবাস করছে, সেটাও তার মঙ্গল এবং সুখের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি ইনস্টিটিউট ফর দ্য কোয়ালিটি অব লাইফ–এর গবেষকেরা ২০২৫ সালের হ্যাপি সিটি ইনডেক্স বা সুখী শহরের সূচক প্রকাশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ৬টি ক্যাটাগরির (নাগরিক, প্রশাসন, পরিবেশ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং চলাচল) মধ্যে ৮২টি সুখ–সংক্রান্ত সূচক পর্যবেক্ষণ করেছেন। সূচকে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো শহরকে চূড়ান্তভাবে ‘সবচেয়ে সুখী’ বলা উচিত নয়। সেখানে ৩১টি শহরকে ‘গোল্ড সিটি’ তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। হ্যাপি সিটি ইনডেক্স এবং বিবিসিতে প্রকাশিত এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১০টি সুখী শহরের তথ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
১.কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক
ডেনমার্ক প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে থাকে। দেশটির রাজধানী কোপেনহেগেনও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সুখী শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানে আছে এটি। পরিবেশ ও অর্থনীতি ক্যাটাগরিতে এগিয়ে আছে কোপেনহেগেন। পরিবেশের ক্ষেত্রে শহরের সবুজ এলাকা, টেকসই জীবনধারা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে মূল্যায়ন করা হয়।
আর অর্থনীতি ক্যাটাগরিতে দেখা হয়—জিডিপি, গড় বেতন, উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানির উপস্থিতির মতো বিষয়গুলো। এ ছাড়া শহরটি নাগরিক ক্যাটাগরিতেও ভালো স্কোর করেছে। গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের মতো সাংস্কৃতিক সম্পদ, বাসিন্দাদের সম্পৃক্ততা এবং স্থানীয় অনুষ্ঠানগুলোকে এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
২. জুরিখ, সুইজারল্যান্ড
সূচকে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে জুরিখ। সুইজারল্যান্ডের এ বৃহত্তম শহরটি নাগরিক ও শাসনব্যবস্থা ক্যাটাগরিতে বেশ ভালো করেছে। শাসনব্যবস্থা বিভাগে নাগরিকদের সরকারি নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ এবং ডিজিটাল সেবার সহজপ্রাপ্তির মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা হয়। শহরটির বাসিন্দাদের মতে, সামগ্রিকভাবে সেখানে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করা যায়। আর এর মধ্য দিয়ে সুখী শহরের শীর্ষ তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে জুরিখ।
৩. সিঙ্গাপুর
নগর–রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর প্রায়ই বিভিন্ন সূচকে শীর্ষস্থানে উঠে আসে। বিশেষ করে ব্যবসার সুবিধা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও উন্নত অবকাঠামোর কারণে এশিয়ার অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে পরিচিত এটি। ২০২৫ সালের ‘হ্যাপিয়েস্ট সিটি ইনডেক্স’-এও নগর–রাষ্ট্রটি স্থান পেয়েছে। বিশেষভাবে ‘স্বাস্থ্য’ ক্যাটাগরিতে ভালো স্কোর করেছে সিঙ্গাপুর। এ ক্যাটাগরিটি সূচকে নতুন যুক্ত হয়েছে। এর আওতায় সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং টিকাদান কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যব্যয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক সুরক্ষার মতো জনস্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্যোগগুলো বিবেচনা করা হয়।
এ ছাড়া শাসনব্যবস্থা বিভাগেও সিঙ্গাপুর সিটি বেশ ভালো স্কোর করেছে। শহরটি এ ক্ষেত্রে যেসব নীতিমালা অনুসরণ করে তার মধ্য দিয়ে শহরের নাগরিকেরা জীবনযাত্রার ব্যয়জনিত চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছেন। অথচ জীবনযাত্রার খরচ বেশি হওয়াটা বিশ্বের বহু শহরের জন্য বড় সমস্যা বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
৪: আরহুস, ডেনমার্ক
ডেনমার্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আরহুসকে বিশ্বের ‘ক্ষুদ্রতম বড় শহর’ বলে ডাকা হয়ে থাকে। সুখী শহরের তালিকায় আরহুসের নামও উঠে এসেছে। শহরটি সব ক্যাটাগরিতে ভালো করেছে, তবে নাগরিক সম্পৃক্ততা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য—এই তিনটি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ভালো স্কোর করেছে। বাসিন্দাদের মতে, এখানকার জীবনযাপন স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শহরটিতে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
৫. অ্যান্টওয়ার্প, বেলজিয়াম
হ্যাপি সিটিজ ইনডেক্সে অ্যান্টওয়ার্প শহরের অবস্থান পঞ্চম। তালিকায় বেলজিয়ামেরই আরেক শহর ব্রাসেলস থেকে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে আছে অ্যান্টওয়ার্প। শহরটি নাগরিক-সম্পৃক্ততা, সরকারি কার্যকারিতা ও পরিবেশ—এই তিনটি ক্ষেত্রে বেশি স্কোর করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা শহরটির নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন, নিরাপদে ও সহজে সাইকেল চালানোর সুবিধা এবং ছোট ও সুনিয়ন্ত্রিত আকারের প্রশংসা করেন। এগুলোর সব কটিই শহরের যাতায়াতব্যবস্থাকে দ্রুত ও সহজ করে তুলেছে।
৬. সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া
সুখী শহরের তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের অবস্থান ষষ্ঠ। সিউল তার আধুনিক জীবনযাত্রা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মাধ্যমে নাগরিকদের সুখী জীবন নিশ্চিত করছে। সিউল ২০২৫ সালের সুখী শহরের সূচকে পরিবহন, পরিবেশ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্যাটাগরিতে ভালো করেছে।
৭. স্টকহোম, সুইডেন
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম ২০২৫ সালের সুখী শহরের সূচকে একটি ‘গোল্ড সিটি’ হিসেবে স্থান পেয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী শহরের তালিকায় থাকা শীর্ষ ৩১টি শহরের মধ্যে একটি এটি। স্টকহোম বিশেষভাবে ‘নাগরিক’, ‘পরিবেশ’ এবং ‘স্বাস্থ্য’ ক্যাটাগরিতে ভালো স্কোর করেছে। ‘নাগরিক’ ক্যাটাগরিতে শহরটি শিক্ষার সুযোগ, সাংস্কৃতিক সম্পদ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রশংসিত হয়েছে।
৮. তাইপে, তাইওয়ান
তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে ২০২৫ সালের সুখী শহরের সূচকে একাধিক ক্যাটাগরিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো করেছে। এশিয়ার অন্যতম সুখী শহর হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া এই শহরটি ‘স্বাস্থ্য’, ‘নাগরিক’ এবং ‘পরিবেশ’ ক্যাটাগরিতে ভালো স্কোর করেছে। স্বাস্থ্য ক্যাটাগরিতে নাগরিকদের চিকিৎসাব্যবস্থায় আর্থিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সহজলভ্যতা এবং সক্রিয় জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়। শহরটির চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম এবং সরকারি উদ্যোগে নিয়মিত টিকাদান ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়।
৯.মিউনিখ, জার্মানি
জার্মানির মিউনিখ শহর ২০২৫ সালের সুখী শহরের সূচকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শাসনব্যবস্থা—এ তিনটি ক্যাটাগরিতে শহরটি উচ্চ স্কোর করেছে। স্বাস্থ্য ক্যাটাগরিতে মিউনিখের ভালো করার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে—আধুনিক ও সুলভ স্বাস্থ্যসেবা, বিস্তৃত বিমা কাভারেজ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি–সংক্রান্ত সরকারি কর্মসূচি। পরিবেশ ক্যাটাগরিতে শহরটির সাফল্য প্রশংসনীয়। সব মিলিয়ে মিউনিখ এমন একটি শহর, যেখানে আধুনিক জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য এবং টেকসই উন্নয়নের সংমিশ্রণে নাগরিকদের জন্য একটি নিরাপদ ও আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
১০. রটারডাম, নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসের বন্দরনগরী রটারডাম ২০২৫ সালের সুখী শহরের সূচকে বিশ্বের সুখী শহর হিসেবে স্থান পেয়েছে। শহরটি বিশেষভাবে স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং শাসনব্যবস্থা ক্যাটাগরিতে উচ্চ স্কোর করেছে। রটারড্যাম তার আধুনিক স্থাপত্য, সবুজ পরিবহনব্যবস্থা এবং উচ্চমানের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পরিচিত। শহরটি ইউরোপের অন্যতম উদ্ভাবনী নগর হিসেবেও বিবেচিত। রটারডাম ২০২৫ সালের সুখী শহরের সূচকে পরিবহন ও পরিবেশ, অর্থনীতি ও ব্যবসা, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা এবং শিক্ষা ও উদ্ভাবনে বেশ ভালো করেছে।