ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, স্বৈরশাসনের পতনের পর মানুষের মনস্তত্ত্ব স্বাভাবিক থাকে না। এর ফলে সমাজের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মানুষজন সাংবাদিকদের নামে মামলা দিলেও ন্যূনতম তথ্য-প্রমাণ ছাড়া সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তবে, সব সরকারের আমলেই সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হুমকির মুখে থাকে। স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না।
শুক্রবার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সংগঠনটির ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর গুলশান ক্লাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে নোয়াব।
উপদেষ্টা বলেন, অনেকবার বলেছি মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, যখন একটা মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। মামলাটা ইনভেস্টিগেশন হবে, চার্জশিট হবে, বিচারিক প্রক্রিয়ায় যাবে। তখন যদি প্রমাণিত হয় মিথ্যা মামলা তখন শুধু আপনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তার আগে আপনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। আমরা সবাই যদি জানিও এটা মিথ্যা মামলা। কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, একটা দেশে ১৫ বছর মিথ্যা মামলার চর্চা হয়েছে, সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যখন হয়েছে আমরা সম্মিলিতভাবে সেভাবে প্রতিবাদ করতে পারি নাই। আপনি যদি বলেন আমরা নিয়মিত হুঙ্কার দেবো, মিথ্যা মামলাকারীদের ছাড় নাই। দেখেন লাভ হয় কি না। এটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। আপনারা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ দেখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায় না। মিথ্যা মামলাকে আমরা নিন্দা করতে চাই।
তিনি বলেন, যারা মিথ্যা মামলা করে তারা শেখ হাসিনার পর্যায়ভুক্ত। কারণ শেখ হাসিনা মিথ্যা মামলা করতো। পুলিশকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া আছে সাবটেন্সি প্রুভ না পেলে কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না। হঠাৎ করে আমরা র্যাডিক্যাল পরিবর্তন আশা করতে পারি, হয়তো বাস্তবায়ন করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, সব সরকারের আমলেই স্বাধীন সাংবাদিকতা হুমকির মুখে থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে তা তুলনাহীন ছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অধিকাংশ সাংবাদিককে দাসে পরিণত করেছিল। যারা দাস হতে চায়নি, তাদের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিল। আওয়ামী লীগ আমলে সাংবাদিকতার আইয়ামে জাহেলিয়্যাত কায়েম হয়েছিল। বাকশাল কায়েম হয়েছিল।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী আমলে সাংবাদিক সম্মেলনগুলো বাংলাদেশের মানুষ ও স্বাধীন সাংবাদিককে অপমান করার একটা ফোরামে পরিণত হয়েছিল। একটা বিকৃত মহিলা তার কিছু তোষামোদকারী নিয়ে পুরো বাংলাদেশের মানুষকে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেছিল।
সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে নিরপেক্ষভাবে চলতে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাদেরকে তাদের ভূমিকা পালন করতে দেন। এরশাদ আমলে সাংবাদিক সংগঠনগুলো এরশাদের পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। শেখ হাসিনার আমলে এরা ফ্যাসিস্ট রেজিম রক্ষার্থে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এ পরিবর্তন থেকে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে বাঁচাতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানকালে সাংবাদিকরা যে ভূমিকা রেখেছিল, সার্বিকভাবে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ গণ-অভ্যুত্থানে অন্যতম উপাদান ছিল সাংবাদিকতা। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি নতুন সময় ও সুযোগ পেয়েছি। আমরা স্বাধীনতার চর্চা করবো, কিন্তু খুব প্রজ্ঞার সঙ্গে করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বর্তমান সরকার ভালো উদ্দেশ্যে অনেকগুলো কাজ করতে চেয়েছে, কিন্তু অনেকেই তা হাইজ্যাক করার চেষ্টা করছে। বাকস্বাধীনতার বাইরেও সাংবাদিকদের সম্মান দেয়ার আছে, সেগুলোতে আমাদের এগিয়ে আসা দরকার। যে ছেলেগুলো খুব কম বেতন পায়, তাদের জন্য নোয়াবের অনেক কিছু করার আছে।
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম বলেন, ফ্রিডম অব প্রেস কিছু শর্তের মধ্যে যেটা উনি বললেন (প্রেস সচিব) ডিগনিটি (সম্মান) সাংবাদিকদের এটা অত্যন্ত জরুরি। আপনারা জানেন গত ৫৩ বছর প্রেস কাউন্সিল ফ্রিডম অব প্রেসসহ অন্যান্য বিষয়ে কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে সাংবাদিকতা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। স্বয়ং শেখ হাসিনার থেকে নোয়াব সরাসরি ঘৃণ্য মন্তব্য ও হামলার শিকার হয়েছিল। সংবিধানে এমন কিছু সংশোধনী আনুন, যাতে আমাদেরকে পূর্ববর্তী সরকারের আমলের মতো ভোগান্তি পোহাতে না হয়।
নোয়াবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, সত্যিকারার্থে আমরা বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। কোনো সরকারকেই আমরা বুঝাতে পারিনি যে, সমালোচনা আপনার সর্বোত্তম বন্ধু। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর আমরা যে চেষ্টা করেছি, সেখানেও ব্যর্থ হয়েছি। গত ১৫ বছরে তা একেবারেই ধূলিস্যাৎ হয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও খুনের মামলায় সাংবাদিকদের জড়ানোটা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। সাংবাদিকরা হত্যা মামলায় জড়িত, এ শ্রেণিতে পৃথিবীতে সম্ভবত আমরা এখন ঊর্ধ্বতম। এখন হয়তো সরকার আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু এ পরিবেশে সাংবাদিকতাও হয় না।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন নোয়াবের সহ-সভাপতি এবং ইংরেজি দৈনিক নিউএজের এডিটোরিয়াল বোর্ডের চেয়ারম্যান এএসএম শহীদুল্লাহ খান।
বণিক বার্তার সম্পাদক নোয়াবের কার্যনিবাহী কমিটির সদস্য দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সম্পাদকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- নোয়াবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, নোয়াবের কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, মানবজমিনের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহবুবা চৌধুরী, দৈনিক সংবাদের সম্পাদক আলতামাশ কবির, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, দৈনিক সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মহাপরিচালক খালেদা বেগম, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রেস অফিসার লিওনার্ড হিল, ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনার পাওয়ান বাধে, ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (পলিটিক্যাল অ্যান্ড প্রেস) গকুল ভিকে, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি মাসদুইপুর, মরক্কোর ডেপুটি হেড অব মিশন বৌচাইব ইজ-জাহারি, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, ট্রান্সকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিমিন রহমান, ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল, প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারস (পিডব্লিউসি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার শামস জামান, অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স পিএলসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কান্তি কুমার সাহা, ইউনিভার্সাল মেডিকেল অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।