অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের থেকে এমন বক্তব্য প্রত্যাশিত, যা দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি-বিতর্ক দূর হবে, তৈরি হবে না।
অতিকথনে কখনও জনজীবনে স্বস্তি আসে না। মানুষের মনে যদি ভয়-শঙ্কা থাকে, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাধারণ কথাও অতিকথন মনে হতে পারে।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল্যায়নের সময় হয়নি। সবেমাত্র কাজ শুরু করছেন। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের কথার সূত্র ধরে কয়েকটি কথা বলা দরকার মনে করছি।
তিনি বলেছেন, 'রাতে আমার কাছে টেলিফোন আসে, অমুক জায়গায় ডাকাতি হয়েছে। আমি বলি যে আল্লাহ আল্লাহ করো, আর কিছু করার নেই।' (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১১ আগস্ট ২০২৪)
উপদেষ্টার এ কথা থেকে মানুষের দিন-রাত কীভাবে কাটছিল, তা বোঝা যায়। যারা রাতে ফোন করেছিলেন, উপদেষ্টার 'আল্লাহ আল্লাহ করো' শোনার পর তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা কি উপদেষ্টা অনুধাবন করেছিলেন? ধরে নেই, করেছিলেন। তারপরের প্রশ্ন, এ কথা তিনি কখন বললেন, কেন বললেন? সত্যি কি কিছু করার ছিল না?
উপদেষ্টারা শপথ নিয়েছেন ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি। রোববার থেকে অফিস শুরু হয়েছে। উপদেষ্টা কথা বলেছেন সোমবার, ১১ আগস্টে। শপথ নেওয়ার প্রথম চারদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি, কথাও শোনা যায়নি। পুলিশ ছিল না এবং সরকারি ছুটির বিষয়টি সামনে আনা যাবে। কিন্তু সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য?
সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার খবর আসছিল দেশের কয়েকটি অঞ্চল থেকে। আর ঢাকা শহরে ছিল ডাকাত আতঙ্ক। পুলিশ না থাকলেও সেনাবাহিনী মাঠে ছিল। তাদের আরও দৃশ্যমান করার সুযোগ ছিল। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হাতে ছিল আনসার, র্যাব, বিজিবি। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে যেসব এলাকায়, সেখানে তাদের মোতায়েনের সুযোগ ছিল। খবর রটে গেল যে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকশ মানুষ সীমান্তে জড়ো হয়েছেন ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। এই সংবাদ কতটা সঠিক, তা দেশের মানুষকে জানানো দরকার ছিল। শুক্র-শনিবার ছুটি এখানে না জানানোর কারণ হতে পারে না। সীমান্ত এলাকায় বা সংখ্যালঘু আক্রান্ত এলাকায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল। একদিনে ১০টি স্থানে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। যে হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষের ওপর গুলি করেছে শেখ হাসিনার সরকার, সেই হেলিকপ্টার ব্যবহার করে স্বরাষ্ট্র বা অন্য উপদেষ্টারা আক্রান্ত ও আতঙ্কিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে পারতেন। তাহলে আতঙ্কিত জনপদে স্বস্তি ফিরে আসত।
ঢাকায় সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে এলাকায় এলাকায় মোতায়েন করলে, র্যাবকে তৎপর করলে, মহল্লার ভেতরে আনসার টহল নিশ্চিত করলে 'ডাকাত গুজব' এতটা ডালপালা মেলতে পারত না।
'চাটুকারিতা করলে মিডিয়া বন্ধ'-এ কথা বলে পরের দিন উপদেষ্টাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। তার মানে কথা বলার আগে চিন্তা করা হয়নি যে মিডিয়া বিষয়ে উপদেষ্টা কি বলবেন!
প্রথমত, মিডিয়া নিয়ে কথা বলা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
দ্বিতীয়ত, কথা বলা যেতে পারে মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে। মিডিয়াকে স্বাধীন করে দেওয়ায় উপদেষ্টাদের ভূমিকা থাকবে, ভূমিকা থাকবে ভয় দূর করার ক্ষেত্রে। নতুন করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়, ড. ইউনূসের সরকারের কেউ তেমন কথা বলছেন, যা অবিশ্বাস্য।
চাঁদাবাজ-সন্ত্রাস প্রসঙ্গে বলেছেন, 'সেনাপ্রধানকে বলেছি, রিকোয়েস্ট করেছি, পা ভেঙে দিতে আপনাদের।' (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১১ আগস্ট ২০২৪)
সেনাপ্রধানকে দিয়ে 'পা ভেঙে' দেওয়াবেন, এটা কোনো উপদেষ্টার ভাষা হতে পারে না।
'মানুষকে দুর্ভোগে ফেলবেন না। তাহলে জনগণকে বলব আপনাদের পিটিয়ে দিতে'—এ ধরণের বক্তব্য মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই দুঃসময়ে এ ধরণের বক্তব্য কী ধরণের বিপদ ডেকে আনতে পারে, উপদেষ্টার তা অজানা থাকার কথা নয়।
রাজনীতি বিষয়ে বলেছেন, 'বাংলাদেশে রাজনীতি হয়েছে চাটুকারদের রাজনীতি। কোনো পলিটিশিয়ান তৈরি করেন নাই, চাটুকার তৈরি করেছেন।' (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১১ আগস্ট ২০২৪)
রাজনীতির চাটুকারিতা নিয়ে কথা বলার সময় এখন না। এ নিয়ে কথা বলার মানুষ দেশে অনেক আছেন। উপদেষ্টাদের কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা, যা গত ১৫ বছরে মানুষ পায়নি। স্থায়ী সমাধানে নীতি প্রণয়নে কী উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা দৃশ্যমান করা।
'আল্লাহর মাল আল্লা নিয়ে গেছে'-বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ চৌধুরীর বক্তব্য, আর ড. ইউনূস সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার 'আল্লাহ আল্লাহ করেন' বক্তব্য বিপজ্জনক ও হতাশার। 'পেটানো' বা 'মিডিয়া বন্ধ'র হুমকির সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের বক্তব্যের মিল খোঁজার চেষ্টা করতে পারে।
'আমি পাবলিকও না, আমি পলিটিশিয়ানও না। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে ফৌজি মানুষ, যা বলব তাই করব।' স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন বক্তব্য সামরিক সরকারের প্রতিনিধির মতো। ফৌজি শাসনের অভিজ্ঞতা তো এ দেশের মানুষের জন্য সুখকর ছিল না।
পুলিশের কাজে যোগদানের আল্টিমেটাম দিয়ে ও আলোচনা করে কাজে যোগদান করানোর প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন উপদেষ্টা। এমন উদ্যোগই তার থেকে প্রত্যাশিত।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের থেকে মানুষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-ব্যবস্থা ও সংবেদনশীল আচরণ প্রত্যাশা করে। মনে রাখতে হবে, টানা ১৫ বছরের অধিক সময় অধিকারবঞ্চিত জনগণ বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে বিশ্ববাসী। এখানে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। ফলে উপদেষ্টাদের অতিকথন ও বিবেচনাহীন বক্তব্য থেকে বিরত থাকা অবশ্য কর্তব্য।
সব উপদেষ্টার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা দরকার আছে কি না, ভেবে দেখা দরকার। উপদেষ্টাদের মধ্য থেকেই কথা বলার জন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের থেকে এমন বক্তব্য প্রত্যাশিত, যা দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি-বিতর্ক দূর হবে, তৈরি হবে না।