ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে এর আগে কখনো কোনো দল পাঁচ গোলে জয় পায়নি-এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জয়।
শনিবার রাতে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ৫-০ গোলের দাপুটে জয়ে শিরোপা নিশ্চিত করেছে পিএসজি, ইউরোপিয়ান ফুটবলে প্যারিসের ক্লাবটির ইতিহাস এখন নতুনভাবে লেখা হবে।
এই জয়ের মধ্যমণি ছিলেন দুর্দান্ত কিশোর ফুটবলার দেজিরে দুয়ে, যার নাম বার্সেলোনার লামিন ইয়ামালের সঙ্গে যুগ্মভাবে ফুটবলের নতুন প্রজন্মের তারকা হিসেবে উঠে আসছে।
ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে নিজের জাত চেনান দেজিরে দুয়ে। লুইস এনরিকে হয়ে ওঠেন ইতিহাস গড়া একজন ব্যক্তি, দুটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ষষ্ঠ কোচ এই স্প্যানিশ।
এনরিকের জন্য এটা কেবল নিছক জয় নয়, ছিল গভীর ব্যক্তিগত আবেগেরও বহিঃপ্রকাশ। ২০১৫ সালে বার্সেলোনার হয়ে শিরোপা জয়ের পর কন্যা জ্যানার হাত ধরে মাঠে উদযাপন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০১৯ সালে ক্যান্সারে ৯ বছর বয়সে মারা যায় জ্যানা। এবার পিএসজির জয়ে এনরিকে পরে ছিলেন একটি বিশেষ টি-শার্ট, যেখানে ছিল তার ও জ্যানার ছবি, পিএসজির পতাকা হাতে। আর তখনই পিএসজির সমর্থকরা দেখান এনরিকে কন্যা জ্যানার প্রতি আবেগঘন শ্রদ্ধাঞ্জলি, বড় একটি ব্যানারে ফুটিয়ে তোলেন বাবা-মেয়ের সেই মুহূর্ত।
“আমি খুবই খুশি,” ম্যাচের পর বলেন এনরিকে।
“শেষ মুহূর্তে সমর্থকদের ব্যানার দেখে আবেগ চেপে রাখতে পারিনি। সবসময় মেয়েকে মনে পড়ে।”
“প্রথম দিন থেকেই বলেছিলাম, বড় শিরোপা জিততে এসেছি। প্যারিস আগে কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেনি। এবার সেটি সম্ভব হয়েছে।”
“অনেক মানুষকে খুশি করতে পেরে দারুণ লাগছে।”
দেজিরে দুয়ে- ১৯ বছরেই বাজিমাত
মাত্র কয়েক মাস আগে আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচে মাত্র ৬৪ মিনিট খেলেই বদলি হয়েছিলেন দেজিরে দুয়ে। তখনো অনেকটাই অনভিজ্ঞ এক তরুণ। কিন্তু মিউনিখের হাই ভোল্টেজ ফাইনালের রাতে তিনি নিজেকে প্রমাণ করলেন এক পরিপূর্ণ সুপারস্টার হিসেবে। ম্যাচের ৬৩তম মিনিটে নিজের দ্বিতীয় এবং পিএসজির তৃতীয় গোলটি করে শিরোপার পথে আরও এক পা বাড়ান তিনি। এর আগে, ম্যাচের ১২তম মিনিটে আক্রমণ শুরু করে আক্রমণভাগে হাকিমিকে দিয়ে প্রথম গোল করান তিনি, এরপর নিজেই করেন দ্বিতীয় গোল।
গোলের কিছু পরেই যখন দেজিরে দুয়েকে তুলে নেওয়া হয়, তখন গোটা স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় ১৯ বছর পেরুনো এই তারকাকে, ঠিক যেন মাঠ ছেড়ে যাচ্ছিলেন এক ‘জেনারেশনাল’ প্রতিভা, যার সামনে রয়েছে দুর্দান্ত এক ভবিষ্যৎ।
দেজিরে দুয়ে- ১৯ বছরেই বাজিমাত
দেজিরে দুয়ে হয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে গোল করা তৃতীয় টিন-এইজ খেলোয়াড়। তার আগে ১৯৯৫ সালে প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট এবং ২০০৪ সালে কার্লোস আলবার্তো একই কীর্তি গড়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ফাইনালে তিনটি গোলে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া তিনিই প্রথম খেলোয়াড়, দুইটি নিজে করেছেন, একটি করিয়েছেন।
১৯ বছর ৩৬২ দিন বয়সে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নস কাপে দুই গোল করার সবচেয়ে কনিষ্ঠ খেলোয়াড়ও এখন তিনিই। এ কীর্তিতে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন পর্তুগিজ কিংবদন্তি ইউসেবিওকেও।
এই ম্যাচ ছিল পিএসজির পূর্ণাঙ্গ এক দলীয় পারফরম্যান্সের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে আসার পথে তারা পরাস্ত করেছে ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল, অ্যাস্টন ভিলা ও আর্সেনালের মতো ইংলিশ জায়ান্টদের।
ইন্টার মিলানের যদি কোনো পরিকল্পনা থেকেও থাকে, পিএসজি তাদের এক মুহূর্তের সুযোগও দেয়নি মাঠে তা কাজে লাগানোর। পিএসজি খেলেছে খুব দ্রুত, ধারালো ও আক্রমণাত্মক ফুটবল। ম্যাচ যত এগিয়েছে, পিএসজি তত তরুণ ও প্রাণবন্ত দেখিয়েছে, আর ইন্টার মিলানকে মনে হয়েছে ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
ম্যাচের আগে বলা হচ্ছিল, পিএসজির স্কোয়াড তরুণ, এখানে ইন্টার মিলান এগিয়ে, পিএসজির গড় বয়স ২৩, ইন্টারের ২৯। তবে ম্যাচ শেষে প্রতিটি মানদণ্ডে পিএসজি ছিল এগিয়ে। ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে এর আগে কখনো কোনো দল পাঁচ গোলে জয় পায়নি, এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জয়।
দেজিরে দুয়ে মাঠ ছাড়ার পরও পিএসজির আক্রমণ থামেনি। খভিচা কভারাটসখেলিয়া এবং ১৯ বছর বয়সী বদলি খেলোয়াড় সেনি মাইউলু আরও দুইটি গোল করেন।
ইন্টার মিলানকে তারা যেভাবে একতরফাভাবে হারিয়েছে, যারা খেলা দেখেছে, তারা অনেক দিন মনে রাখবে। বিবিসির প্রধান ফুটবল লেখক ফিল ম্যাকনাল্টি লিখেছেন, “যারা ইউরোপে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে চায়, তাদের জন্য এটা এক নতুন মানদণ্ড তৈরি করে দিল পিএসজি।”
ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে এর আগে কখনো কোনো দল পাঁচ গোলে জয় পায়নি-এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জয়।
মিউনিখের এক ঐতিহাসিক রাতে প্যারিসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম শিরোপা জিতে আবেগে কেঁদে ফেলেন প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনের কোচ লুইস এনরিকে। ছবি: গেটে ইমেজ
নাসের আল খেলাইফির স্বপ্নপূরণ
কিলিয়ান এমবাপে, নেইমার আর লিওনেল মেসির মতো তারকাদের বিদায়ের পর অনেকেই ভেবেছিলেন পিএসজির দিন বুঝি শেষ। কিন্তু লুইস এনরিকে যেন সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগালেন। তিনি বোঝাতে পেরেছেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট নাসের আল-খেলাইফি এবং ফুটবল উপদেষ্টা লুইস ক্যাম্পোসকে, এমবাপের পরবর্তী যুগেও পিএসজিকে নতুনভাবে গড়া সম্ভব। এই ফাইনাল তার সেই বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
পিএসজির প্রেসিডেন্ট নাসের আল খেলাইফি, আমেরিকান টিভি চ্যানেল সিবিএসকে বলেন “এটাই আমাদের ক্লাবের ইতিহাসের সেরা মৌসুম।”
“আমরা ভবিষ্যতের জন্য দল গড়ছি। আজকের ফলাফল যাই হোক না কেন, আমাদের পরিকল্পনা বদলাবে না। আসল কাজ এখন শুরু। আমাদের আরও বিনয়ী হতে হবে, বাস্তববাদী হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি খুবই গর্বিত, ভক্তদের জন্য, ফ্রান্সের জন্য। শুধু প্যারিস নয়, পুরো ফ্রান্স এই অর্জনের যোগ্য। আমাদের দারুণ লিগ আছে, ঐতিহ্যবাহী কিছু ক্লাব আছে। আমি নিশ্চিত, এই অর্জনের পর লিগ আরও ভালো হবে।”
“আমরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। আমরা ফরাসি ফুটবলের জন্য কিছু করতে চেয়েছি, কিন্তু তাও সমালোচনা এসেছে। সেটা অবশ্যই কষ্ট দিয়েছে, তবে আমি নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলাম।”
সবশেষে পিএসজি প্রেসিডেন্ট যোগ করেন, “এই বছরটিকে আমরা সেরা বছর হিসেবে পরিকল্পনা করিনি। কিন্তু আজ, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় দলটা প্রমাণ করেছে, আমাদের আছে বিশ্বের সেরা কোচ, সেরা খেলোয়াড় এবং দারুণ সব সমর্থক।”
ইন্টার মিলানের জন্য কি যুগের শেষ?
৫-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ইন্টার মিলান শুধু ট্রফি হারায়নি, তাদের সামনে নিজেদের দল নিয়ে নতুন করে ভাবারও সময় এসেছে, যদিও তা করতে হবে সীমিত বাজেটেই।
ইন্টার কোচ সিমোনে ইনজাগির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তিনি এমন একটি দল নিয়ে মাঠে নামেন, যারা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ইতিহাসে তৃতীয় প্রাচীনতম স্কোয়াড হিসেবে রেকর্ড গড়ে।
দুই বছর আগে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ফাইনালে খেলা সাতজন আবারও একাদশে ছিলেন।
“এই খেলোয়াড়রা সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়েছে। আমি এই দলটিকে আর কারো সঙ্গে তুলনা দেবোনা,“ ম্যাচ শেষে বলেছিলেন ইনজাগি, তবে তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি ক্লাব বিশ্বকাপে দলের দায়িত্বে থাকবেন কি না।
মাঠে পিএসজির তারুণ্য আর গতি সামলাতে পারেনি অভিজ্ঞ ইন্টার দল। যে মৌসুমে ট্রেবল জেতার স্বপ্ন দেখছিল তারা, সেটি শেষ হলো শূন্য হাতে। ফ্রানচেস্কো অ্যাচারবি, ইয়ান সোমার এবং হেনরিখ মাখিটারিয়ান, এই তিনজনই বয়সে ৩৬ বা তার বেশি।
ইন্টার তাই ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে এক ম্যাচে এমন তিনজন খেলোয়াড় মাঠে নামানো প্রথম দল হয়ে গেল।
“ম্যাচ যত এগিয়েছে, স্কোরলাইন যত বেড়েছে, ততই ইন্টারকে এই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বয়স্ক দলের মতোই দেখিয়েছে,” বলছিলেন বিবিসির ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’ বিশ্লেষক নেদাম ওনুহা।