শুক্রবার ৯ মে ২০২৫ ২৬ বৈশাখ ১৪৩২
শুক্রবার ৯ মে ২০২৫
 
রাজনীতি
নির্বাচনের আগে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে: এনসিপি





প্রথম আলো
Wednesday, 7 May, 2025
12:13 AM
 @palabadalnet

 গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে ‘বর্ধিত আলোচনা’য় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে ‘বর্ধিত আলোচনা’য় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ‘মৌলিক সংস্কারের’ রূপরেখা তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলেছে, মৌলিক সংস্কারের মূল লক্ষ্য তিনটি-ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও বিকেন্দ্রীকরণ।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বর্ধিত আলোচনায় এনসিপি তাদের রূপরেখা তুলে ধরে। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন যেকোনো সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার দৃশ্যমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।

সংস্কার প্রশ্নের ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করছে কমিশন। এর অংশ হিসেবে এনসিপির সঙ্গে এদিন আবার আলোচনা করেছে কমিশন। এর আগে গত ১৯ এপ্রিলও দলটির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়েছিল। মঙ্গলবার এনসিপির সঙ্গে কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে।

মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপি বুঝিয়েছে, স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন। তারা রূপরেখায় বলেছে, গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য শুধু একটি নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া নয়, অবশ্যই নির্বাচন ক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করার মূল উপাদান। কিন্তু ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক অনুশীলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কি না, তা কখনোই শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় না।

১৯৯১ সালে সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ও এর পরের পরিস্থিতি তুলে ধরে রূপরেখায় বলা হয়, ‘যদি আমরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি, অর্থাৎ মৌলিক সংস্কার আমলে না নিয়ে নির্বাচনমুখী ন্যূনতম সংস্কারের ওপর মনোনিবেশ করি (যা কেবল একটি অস্থায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে) তাহলে বাংলাদেশ আবারও স্বৈরশাসনের ঝুঁকিতে পড়বে।’

এনসিপির রূপরেখায় মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো সাংবিধানিক ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার।

এনসিপি যেসব মৌলিক সংস্কারের কথা বলছে, তার অনেকগুলো সংবিধান-সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছে দলটি। তারা বলেছে, সামনে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।

আলোচনা শেষে বিকেলে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কতটুকু সংস্কার অবশ্যই করতে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে, সংস্কারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা তারা কমিশনে জমা দিয়েছেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আখতার হোসেন বলেন, তারা যে রূপরেখা তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়।

আখতারের বক্তব্যের আগে এনসিপির রূপরেখার সারসংক্ষেপ সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।

সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতার ভারসাম্য

এনসিপি তাদের রূপরেখায় বলেছে, নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন করতে হবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দেবে এই কাউন্সিল। আইনসভা হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ বিদ্যমান পদ্ধতিতে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ভোটের আনুপাতিক হারে। সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন। তবে সরকারের স্থিতিশীলতাও যেন ঠিক থাকে, সে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এনসিপির রূপরেখায় বলা হয়েছে, ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ১৬ বছর এবং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ২৩। তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। মৌলিক অধিকারবিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানে এ-সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ সংস্কার করতে হবে।

নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রূপরেখায় কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। একই ব্যক্তি একসঙ্গে দলনেতা, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। বিরোধী দল ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবে। জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটি; পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে (তবে সরকারের প্রতি অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে না)।

স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে রূপরেখায়। এর মধ্যে আছে সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, ইসির নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা; ইসির মেয়াদে বা মেয়াদ-পরবর্তী সময়ে ইসির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্তের ব্যবস্থা; সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন; ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পরও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলে ফলাফল বাতিল ইত্যাদি।

বিচার বিভাগ ও অন্যান্য

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল কমিশন ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা, আপিল বিভাগে বিচারপতি পদোন্নতিতে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং বিভাগীয় শহরগুলোয় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে দুদককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে জনপ্রশাসনে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিকেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সংস্কার কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো কমিশনের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়নি। তারা বলে আসছেন, বর্তমান সংবিধান স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোতে ভরপুর। এর বাইরে নতুন একটি সংবিধানের কথা বলেছেন তারা। নতুন সংবিধান বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই গণপরিষদ প্রয়োজন। সে জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সামনের দিনে আলোচনা করবেন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়েও তারা একটি লিখিত প্রস্তাব কমিশনকে দেবেন।

আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে এনসিপির প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না—এমন প্রশ্নে আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অনেক ধরনের বক্তব্য আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে সামনের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। এনসিপি মনে করে, সরকারের তরফ থেকে বিচার ও সংস্কারকাজ যদি দৃশ্যমান হয় এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা থাকে, তাহলে এ সময়কালের মধ্যে সেটাকে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব এবং নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।

এর আগে দুপুরে আলোচনার বিরতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ ও উচ্চ কক্ষ-দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোটে বিধান থাকতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, ছোটখাটো সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটে যেতে হবে কি না। পাওয়ার স্ট্রাকচার (ক্ষমতাকাঠামো), প্রস্তাবনা ও মূলনীতির মতো সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় সংশোধনের জন্য অবশ্যই গণভোটে যেতে হবে বলে তারা মনে করেন। তবে ছোট সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধ্যকতা রাখার প্রয়োজন নেই।

জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের পথরেখা

এনসিপির সঙ্গে আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, তা তারা গ্রহণ করেছেন। পর্যালোচনা সাপেক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ রূপরেখার একটি প্রতিফলন পাওয়া যাবে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকসহ বিভিন্নভাবে কমিশনের আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে। এ অব্যাহত আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা, যা গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের পথরেখা নির্দেশ করবে।

আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।

অন্যদিকে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলের মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ও জাবেদ রাসিন এবং সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) আরমান হোসাইন আলোচনায় অংশ নেন।

পালাবদল/এসএ


  সর্বশেষ খবর  
  সবচেয়ে বেশি পঠিত  
  এই বিভাগের আরো খবর  


Copyright © 2025
All rights reserved
সম্পাদক : সরদার ফরিদ আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক : জিয়াউর রহমান নাজিম
ফোন : +৮৮-০১৮৫২-০২১৫৩২, ই-মেইল : palabadal2018@gmail.com