
জুলাই বিপ্লবী ওসমান হাদি। ফাইল ছবি
চলে গেলেন জুলাই বিপ্লবী ওসমান হাদি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টা দিকে তিনি মারা যান। বৃহস্পতিবার রাতে ওসমান হাদির ভাই ওমর হাদি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া ওসমান হাদির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এর আগে গতকাল বুধবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছিল, গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। সেই ঘোষণার পর থেকে তার জীবন নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা বাড়তে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে দোয়া ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী বক্তব্যের কারণে শরিফ ওসমান হাদি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ছিলেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা হাদিকে গুলিবর্ষনকারী হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতাকে শনাক্ত করে। ওই আসামি ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে আলোচনা রয়েছে।
ঢাকা-৮ আসনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ওসমান হাদি। মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের উদ্যোগে তাকে গত সোমবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়।
ওসমান হাদিকে দিনে-দুপরে গুলি করে হত্যাচেষ্টার এই ঘটনার পরপরই দেশে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘটনাটিকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নির্বাচনের পথে গুপ্ত হামলা, নাশকতা বাড়তে পারে।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক মাস আগেই হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছিলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে ফোন ও মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকেরা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে পিছিয়ে যাবেন না।
ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা শরিফ ওসমান হাদিকে শুরুতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখা যায়নি। মাদ্রাসার শিক্ষক বাবার সন্তান হাদি নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে ধারাবাহিক সমাবেশ আয়োজন করেন হাদি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হলেও পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। দ্রুত তার বড় একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন তিনি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতেও ছিলেন সরব। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষেও প্রকাশ্যে মত দেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাদি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিলেও পরে নতুন দল এনসিপিতে যোগ দেননি। বরং ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাস ধরে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, ভোটারদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ ও ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ-সবই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতেন।
ওসমান হাদিকে হত্যার এই ঘটনাকে নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘পলাতক ফ্যাসিস্ট শক্তির’ সহিংসতার একটা সতর্ক বার্তা হিসেবে দেখছে সরকার।
ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক ও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। তাদের মধ্যে প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগম (৬০), স্ত্রী সাহেদা পারভিন সামিয়া ও শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু রয়েছেন।
গ্রেপ্তার বাকি ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন মো. নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, মো. কবির, আব্দুল হান্নান, মো. হিরন, মো. রাজ্জাক, ফয়সালের বান্ধবী মারিয়া আক্তার এবং হালুয়াঘাট সীমান্তে মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিত সিমিরন দিও ও সঞ্জয় চিসিম।
পালাবদল/এসএ