
বৈঠকের পর এনসিপির নেতাদের সংবাদ সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা: জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে ‘ভাগ-বাঁটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে অভিযোগ করে সেই উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ চেয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আজ বুধবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এ দাবি জানিয়েছে তারা।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক শেষে বেরিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “জনপ্রশাসনে যেভাবে বদলি-পদায়নগুলো হচ্ছে, সেটা কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে, নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন হচ্ছে কি না...। কারণ, আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি-ডিসি ভাগ-বাঁটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা সরকারকে সেগুলো দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও সেই দলগুলোর সঙ্গে সে ব্যাপারে সহায়তা করছে।”
এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে সতর্ক করে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “সরকার যাতে নিরপেক্ষভাবে ফাংশন (কার্যক্রম পরিচালনা) করে এবং উপদেষ্টা পরিষদে যাঁদের বিরুদ্ধে এই সংশ্লিষ্টতাগুলো রয়েছে, অদক্ষতা-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলীয় পক্ষপাতের, তাদের বিষয়ে যাতে প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত নেন।”
নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরকারকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানায় বিএনপি। একই সঙ্গে সরকারের মধ্যে দলীয় লোক থাকলে তাদের অপসারণ করারও দাবি জানায় দলটি। এর ধারাবাহিকতায় আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এনসিপির নেতারা। সাক্ষাতে নাহিদ ইসলাম ছাড়াও এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ ছিলেন।
বিএনপি গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কাছে সরকারকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা’ নেওয়ার যে দাবি জানিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদকে। জবাবে তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টা কিন্তু জুলাই সনদের আওতাধীন। সে বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে। সেখানে নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) বিষয়টা আছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুলাই সনদে আসবে, গণভোটের পরেই এ বিষয়ে আসলে চূড়ান্ত হওয়া সম্ভব। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যাওয়ার কোনো ধরনের সুযোগ নেই। ফলে এই কথা যদি কেউ বলে থাকে, তাদের কোনো ধরনের দুরভিসন্ধি রয়েছে।”
বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ পুরো পরিবর্তনের সুযোগ নেই বলে মনে করেন এনসিপির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা লাগবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। সে দাবির সঙ্গে ভিন্নমত নেই। কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ পুরো পরিবর্তন করতে হবে, এটার আসলে সুযোগ নেই।”
ছাত্র উপদেষ্টা কোনো দলের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে নেই উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, “ছাত্র উপদেষ্টাদের বিষয়ে যেটা বারবার বলা হয়, তারা কোনো দলের প্রতিনিধি হিসেবে কিন্তু সরকারে নেই, গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে রয়েছে। ফলে অন্য উপদেষ্টারা যে রকম ছাত্র উপদেষ্টারাও সে রকম। ছাত্র উপদেষ্টাদের ক্ষেত্রে যদি কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্টতা হিসেবে দেখা হয়, অন্য অনেক উপদেষ্টারও বিভিন্ন দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।”
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নয়, অন্য যে উপদেষ্টাগুলো রয়েছে, আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে সেই নামগুলো বলেছি যে কারা কারা, কোন কোন দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বা প্রশাসনের ভাগ-বাঁটোয়ারার সাথে জড়িত আছে। ফলে সার্বিকভাবে এটা বিবেচনা করতে হবে।”
এ ছাড়া বৈঠকে জুলাই গণহত্যার বিচার, জুলাই সনদ নিয়েও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “যেহেতু জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়েছে এবং এনসিপি সেখানে অংশগ্রহণ করেনি, আমরা আমাদের অবস্থান সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। বলেছি, জুলাই সনদের শুধু কাগজে মূল্যে আমরা বিশ্বাসী নই। জুলাই সনদের বাস্তবায়নটা কীভাবে হবে, সেটার সম্পর্কে নিশ্চয়তা পাওয়ার পরে আমরা স্বাক্ষর করব। সে ক্ষেত্রে আমরা একটি সাংবিধানিক আদেশের কথা বলছি, যে আদেশটা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (প্রধান উপদেষ্টা) প্রধান হিসেবে জারি করবেন। কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের যে সার্বভৌম ক্ষমতা, সেটার একমাত্র বৈধতা অধ্যাপক ইউনূসেরই আছে, সেটা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুর নেই। ফলে সাংবিধানিক আদেশ, যেটা সংবিধানবহির্ভূত হিসেবে দেওয়া লাগবে, সেটা কোনোভাবেই প্রেসিডেন্ট চুপ্পু দিতে পারবে না, সেটা অধ্যাপক ইউনূসকে দিতে হবে। সেটার আইনি এবং রাজনৈতিক কারণ আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছি।”
বৈঠকে নির্বাচন কমিশন নিয়ে এনসিপির পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে বলে জানান নাহিদ। তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান আচরণ-আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে এটা নিরপেক্ষ হচ্ছে না, স্বচ্ছ হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেভাবে কার্যক্রম করার কথা ছিল, সেটা করছে না। কিছু কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে এবং কোনো কোনো দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ তারা করছে।”
বিগত সময়ে নির্বাচন কমিশন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে কীভাবে তাদের ‘পক্ষপাতিত্ব ফুটে উঠেছে’, সে বিষয় বৈঠকে তুলেছেন বলে জানান এনসিপির আহ্বায়ক। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয়, এর দায় সরকারের ওপর আসবে। আমরা সরকারকে সে বিষয়টি অবহিত করেছি। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশন এই মুহূর্তে পুনর্গঠন হওয়া প্রয়োজন।”
এ ছাড়া বৈঠকে বিসিএস নন-ক্যাডার বিধিমালা, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ একটা পরিস্থিতি-পরিবেশ তৈরি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কথা শুনেছেন এবং বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন।”
পালাবদল/এসএ