নরেন্দ্র মোদিই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি ইসরায়েল সফর করেছেন। ফাইল ছবি
ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও); কিন্তু এ সংস্থার সদস্য হলেও ইসরায়েলকে নিন্দা জানানোর আলোচনা থেকে ভারত নিজেদের দূরে রেখেছে-নিন্দা জানানোর সিদ্ধান্তেও সমর্থন দেয়নি।
এতে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান এই সংঘাত নিয়ে ইউরেশীয় অঞ্চলের প্রভাবশালী এই রাজনৈতিক জোটের ভেতর মতপার্থক্যের ইঙ্গিত মিলেছে।
ইসরায়েল নিজের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের ওপর যে নজিরবিহীন হামলা চালাচ্ছে, তা গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ কারণে বিশ্বনেতারা বারবার এ যুদ্ধ উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছেন।
গত শুক্রবার ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর চলমান এই সংঘাতের সূত্রপাত হয়।
এর আগে ২০২৪ সালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দুই দফা সরাসরি সামরিক সংঘাত হয়, যার শুরু হয়েছিল ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে। জবাব দিতে ইরান প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা চালিয়েছিল।
এবার রাজধানী তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন শহরের আবাসিক ও সামরিক এলাকাগুলো ইসরায়েলি হামলার নিশানা হয়েছে। এসব হামলায় অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন বলে জানিয়েছে ইরান।
হামলায় ইরানের কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) বেশ কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের কমান্ডার নিহত হয়েছেন।
পরদিন শনিবার ইরানের বিভিন্ন তেল শোধনাগার, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও তেল মজুতের স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েল।
পাল্টা জবাবে তেহরান ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফা শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইরানের হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
এসসিও একটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্লক। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির সদস্য চীন, বেলারুশ, ভারত, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান। সবচেয়ে নবীন সদস্য ইরান ২০২৩ সালে এসসিওতে যোগ দেয়, সে সময়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ছিল ভারত।
এ সংঘাতের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত করেছে তেহরান।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে বাকি বিশ্ব নিজেদের অবস্থান জানাতে শুরু করছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থাও এ সংঘাত নিয়ে আলোচনা করেছে এবং ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে; কিন্তু ভারত ওই আলোচনা এবং ইসরায়েলের নিন্দা জানানো থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। তবে কি ভারত ইসরায়েলকে সমর্থন করছে?
এসসিও কী বলেছে
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) একটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্লক। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির সদস্য চীন, বেলারুশ, ভারত, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান।
সংস্থাটির সবচেয়ে নবীন সদস্য ইরান। দেশটি ২০২৩ সালে এসসিওতে যোগ দেয়। সে সময়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ছিল ভারত।
বর্তমানে এসসিওর চেয়ারম্যান চীন। গত শনিবার এসসিওর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার তীব্রতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সামরিক হামলার কঠোর নিন্দা জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামোসহ বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের মারাত্মক লঙ্ঘন। এ হামলা বেসামরিক প্রাণহানির কারণ হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, (ইসরায়েলের হামলা) ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ, যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণ এবং বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকির সৃষ্টি করেছে।
ইরানের সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এসসিও সদস্য রাষ্ট্রগুলো জোর দিয়ে বলেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার সমাধান শুধু শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে হওয়া উচিত।
ভারত কি কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করছে
তেহরানে ইসরায়েলের প্রাথমিক হামলার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই ফোনালাপে জয়শঙ্কর বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিয়েছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি যেকোনো ধরনের উত্তেজনাকর পদক্ষেপ এড়িয়ে চলা এবং দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার আহ্বানও জানিয়েছেন।
শুক্রবার এক পৃথক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘পরিস্থিতির অগ্রগতি যেভাবে হচ্ছে, বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা–সম্পর্কিত প্রতিবেদনের দিকে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছি। উভয় পক্ষকে আলোচনা ও কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে পরিস্থিতি উত্তরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হচ্ছে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ভারত উভয় দেশের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং সব সম্ভাব্য সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
ম্যাসাচুসেটস-অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শান্তি ডি’সুজা আল–জাজিরাকে বলেন, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারত একটি বিশেষ অবস্থানে আছে। কারণ দেশটিকে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এবং ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখতে হয়।
ইসরায়েলের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত। আল–জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভারতের অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৪ সালে গাজা যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েলের কাছে রকেট ও বিস্ফোরক বিক্রি করেছে।
ইসরায়েলের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত। অন্যদিকে ভারত ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন করে এটিকে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে নিজেদের পণ্য রপ্তানির একটি প্রধান দ্বার হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে।
অন্যদিকে ভারত ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন করে এটিকে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে নিজেদের পণ্য রপ্তানির একটি প্রধান দ্বার হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে।
শান্তি বলেন, ভারত সূক্ষ্মভাবে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখছে।
এসসিও ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার পর নয়াদিল্লি বলেছে, তারা ওই বিবৃতি–সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নেয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের আগের বিবৃতির কথা উল্লেখ করে আরও বলা হয়, ভারত এসসিও-র অন্যান্য সদস্যের কাছে নিজের সামগ্রিক অবস্থান উল্লেখ করেছে।
ভারত কি তবে ইসরায়েলকে সমর্থন করছে
স্পষ্টভাবে না বললেও নয়াদিল্লি নিজেদের দূরে রাখায় এসসিওর ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দার প্রভাবকে দুর্বল করে দিয়েছে।
এসসিওর নিন্দা জানানোর অবস্থান থেকে নিজেকে দূরে রাখার এক দিন আগে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গাজায় ‘তাৎক্ষণিক, শর্তহীন ও স্থায়ী’ যুদ্ধবিরতির খসড়া প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত ছিল।
দিল্লিভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের উপপরিচালক কবির তানেজা বলেন, জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভারতের ভোটদান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত বিভ্রান্তিকর।
তানেজার মতে, হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছা থেকে ভারত এটা করছে।
এ বিষয়ে তানেজা বলেন, ভারত ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির খুব কাছে পৌঁছে গেছে। এমন একটি চুক্তি যা তারা জুলাইয়ের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহারের আগেই করার চেষ্টা করছে।
কবির তানেজা ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি এক পাশে সরিয়ে রেখে ইসরায়েল বিষয়ে নয়াদিল্লির অবস্থানের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে এসসিও জোটের প্রকৃত কাঠামো প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে ভারত অনেকটাই একজন ব্যতিক্রমী সদস্য হিসেবে অবস্থান করছে। চীন ও রাশিয়া ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে নয়াদিল্লির জন্য এসসিওর বিবৃতিতে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট ভাষা ও অবস্থানে সম্মতি দেওয়া খুব কঠিন হতো।
ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ইরান ছিল ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল সরবরাহকারী দেশ।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ইরানকে চাপে রাখতে তিনি অর্থনৈতিক চাপের কৌশল আরও জোরালো করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি ওই সব নিষেধাজ্ঞা ছাড়ের সুবিধা স্থগিত করেন, যেগুলো ইরানকে আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছিল। এর মধ্যে ইরানের চাবাহার বন্দর প্রকল্প–সংক্রান্ত ছাড়ও ছিল।
এই বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে ইরানের মাধ্যমে স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চাবাহার বন্দর প্রকল্পে কাজ চালিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা ছাড়ও আদায় করেছিল ভারত।
এখন ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নে নয়াদিল্লির কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু ইরানের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতের আগ্রহ শুধু চাবাহার বন্দর প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
কবির তানেজা বলেন, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মতো অঞ্চলগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।