শতরান করে আউট হয়ে ফেরার পথে এডেন মার্করাম। ছবি: রয়টার্স
জশ হেজলউডের বলটা তার ব্যাটে না লেগে কোনো ভাবে প্যাডে লাগলে, রূপকথার আগেই শেষ হয়ে যেত ইনিংস। হয়তো দল জিতত, বা জিতত না। কিন্তু একটা স্মরণীয় কাহিনি লেখা থেকে বঞ্চিত থেকে যেতেন এডেন মার্করাম। হয়তো ক্রিকেটঈশ্বর সেটা চাননি। তাই বল ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লাগল। মিড উইকেট দিয়ে পৌঁছে গেল বাউন্ডারিতে।
ধাবমান বলের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়েছিলেন তিনি। বল বাউন্ডারির দড়ি ছোঁয়ার পর স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। হেলমেট খুলে, ব্যাট তুলে দর্শকদের অভিবাদন নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মাঝে চোখও একটু মুছে নিলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন টেম্বা বাভুমা। ব্যাটে গ্লাভস দিয়ে চাপড় মেরে হাততালি দিচ্ছিলেন। এই মুহূর্তটার মধ্যে কোনো ভাবেই ঢুকে পড়ে নজর চুরি করে নিতে চাননি।
শনিবার, লর্ডসের নরম রোদের তলায় মার্করাম যে শতরান করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে তার ক্রিকেটজীবনের অন্যতম সেরা হয়ে থেকে যাবে। আসলে এই শতরান টেস্ট বিশ্বকাপ জিতে দেশের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেওয়ার, এই শতরান শত বঞ্চনার জবাব দেওয়ার, এই শতরান দীর্ঘ দিন ধরে দেশের নামের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ‘চোকার্স’ তকমা ঘোচানোর, এই শতরান স্বপ্নপূরণের।
২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপ জেতানোর পর থেকেই মার্করামকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার একটা গর্ব ছিল। তার নেতৃত্বের সঙ্গে তুলনা হত গ্রেম স্মিথের, তার স্ট্রোকের সঙ্গে তুলনা হতো এবি ডিভিলিয়ার্সের, তার নিরুৎসাহী মনোভাবের সঙ্গে তুলনা হত ড্যারিল কালিনানের।
তবু তার পাশে দাঁড়ানো মানুষদের বার বার হতাশই করেছেন মার্করাম। টেস্ট জীবনের শুরুটা ভালোই হয়েছিল। অভিষেক ম্যাচে ৯৭, চতুর্থ এবং পঞ্চম ইনিংসে শতরান। তার পরেও ৪৬ টেস্টের শেষে তার গড় ঘোরাফেরা করছিল ৩০-এর আশেপাশে। কিছুই যেন ঠিকঠাক হচ্ছিল না। অথচ সেরা ব্যাটার হওয়ার সব রকম গুণই তার মধ্যে ছিল। অসাধারণ স্ট্রোক নেওয়ার ক্ষমতা, সঠিক টাইমিং এবং টাচ, ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতা— সবই ঠিকঠাক। তবু কোথাও একটা খামতি থেকে যাচ্ছিল। টেস্ট বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে তার ৩৫.৯২ গড় এবং সাতটি টেস্ট শতরান মোটেই প্রতিভার সঠিক প্রতিফলন ছিল না। ম্যাচের পর অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাও বললেন, “দু’মাস আগেই প্রশ্ন উঠছিল, ও কেন দলে রয়েছে। আশা করি এ বার সবাই উত্তর পেয়ে গিয়েছে।”
সব ব্যাটারের মতো মার্করামের খেলাতেও খুঁত আছে। তবে এমনও নয় যা তার ক্রিকেটজীবন থমকে দিতে পারে। ক্রিজ়ের মধ্যে থেকে শট মারার চেষ্টা করা, সামনের পায়ে খেলা, অকারণে বাউন্সার তাড়া করে শট মারতে যাওয়া-এ সব ভুলগুলো চাইলেই শুধরে ফেলা যায়। তা শোধরানোর চেষ্টাও করেছেন মার্করাম। এত দিন খুব বেশি কাজে আসেনি। মার্করামকে নিয়ে এক সময় যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল তা এক সময় থিতিয়ে যায়।
তাকে ঘিরে এই প্রত্যাশা কমে যাওয়া আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় মার্করামের জীবনে। বয়ে আসে তাজা বাতাস। অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। সমাজমাধ্যম পুরোপুরি বর্জন করেন, সংবাদপত্র পড়া ছেড়ে দেন। শুধু ক্রিকেট খেলে নিজের মতো বাঁচার দিকে মনোযোগ দেন। ফলও মেলে। সাদা বলের ক্রিকেটে বিশ্বের অন্যতম সেরা হয়ে ওঠেন। বিশ্বের টি-টোয়েন্টি লিগে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। তবে টেস্টে সাফল্যের সূত্র তখনও খুঁজে পাননি। এক বার বলেছিলেন, “সংখ্যা নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি। শতরান করতে পারলাম কি না আর দেখি না। দলকে জেতাতে পারলাম কি না সেটাই দেখি।” কে জানত, তার একটা শতরান দলকে শুধু বাঁচাবেই না, তার কেরিয়ারকেই আবার তুলে আনবে পাদপ্রদীপের আলোয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল কেরিয়ারের উত্থানে সাহায্য করেছিল। কোনো রকম চাপ ছাড়াই খেলতে পারছিলেন। চাপের সামনে খোলসে ঢুকে যাননি। মনঃসংযোগ নিয়ে আগে সমস্যা হত। এখন আর হয় না। ফাইনালের তৃতীয় দিন মিচেল স্টার্ককে এমন মার মেরেছিলেন যে, ন’ওভারের পর দলের সেরা বোলারকে আর বল করানোর সাহসই পাননি অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। শনিবার হঠাৎ করে বিরাট কোহলির সাত বছর আগের একটা পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। ২০১৮-র ২৪ মার্চ কোহলি লিখেছিলেন, “এডেন মার্করামকে দেখা চোখের আরাম।” সে বার এই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই নিউ ল্যান্ডসে ৮৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মার্করাম।
ঠিক এই কারণেই তাকে ভুলে যায়নি দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা জানত, বড় ম্যাচে তার মতো ক্রিকেটারকেই দরকার। ম্যাচের পর বাভুমা বলেন, “পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মার্করামের দৃঢ়তা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” বলে রাখা ভালো, তৃতীয় দিন বাভুমা চোট পাওয়ার পর তাকে তুলে নিতে চেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। মার্করামই বারণ করেন। জানান, ম্যাচ জেতার জন্য তাদের এই জুটিটা গুরুত্বপূর্ণ। ছন্দটা ভাঙতে চাননি। সেটা যে কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, এখন তা পরিষ্কার।
দায়িত্ব পালন করলেও এখনও কৃতিত্ব নিতে শেখেননি মার্করাম। তাই ম্যাচের সেরার পুরস্কার নেওয়ার পর সঞ্চালক নাসের হুসেন যখন প্রশ্ন করলেন যে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রান তিনিই করেছেন কি না, মার্করামের জবাব, “একেবারেই নয়। প্রথম ইনিংসে অদ্ভুত ভাবে আউট হয়েছিলাম। এবার ভাগ্য সঙ্গ দিল।” একটু থেমে যোগ করলেন, “লর্ডসে এমন একটা মাঠ যেখানে সবাই রান খেলতে চায়। মাঠে অনেক সমর্থক ছিলেন। ওদের আনন্দ দিতে পেরেছি, এটা ভেবেই ভালো লাগছে।”
সতীর্থেরা এত সহজে ছাড়েননি। যাবতীয় উল্লাস চলছিল তাকে ঘিরেই। পরিবার, সতীর্থদের মাঝে থেকেও মাঝেমাঝে তাকাচ্ছিলেন আকাশের দিকে। হয়তো ভাবছিলেন, ভাগ্যের বদল শনিবার থেকেই শুরু হলো কি না।