সত্যি বলতে, আমরা গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুশাসন, সরকারি সংস্থার জবাবদিহিতা, করপোরেট সুশাসন, সৎ নেতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের মতো বিষয়ে পুরোপুরি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সামনে ছিল কেবল চাটুকারিতা আর দুর্নীতি। আমাদের কাছে বিকল্প ছিল শুধুই তাদের পদলেহন, নয়তো তাদের পকেট ভরতে সহায়তা করা।
শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে সেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। যে দরজাগুলো শুধু চাটুকারদের জন্য খোলা ছিল, সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে এই ছাত্র-জনতা। হঠাৎ করেই আবার আমরা বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি, স্বপ্ন দেখছি। তবে স্বপ্ন যেমন সুন্দর, তেমন ভঙ্গুরও বটে। এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের স্বপ্ন পূরণের পথকে বন্ধুর করে তুলছে। এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন জাগাচ্ছে এবং তাদের সক্ষমতা নিয়ে দ্বিধা তৈরি করছে। সিস্টেমের ভেতরে ও বাইরে উভয় জায়গা থেকেই এটা হচ্ছে।
শুরুতেই সিস্টেমের ভেতরের পুলিশের কথায় আসা যাক। সদ্য সাবেক সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও গণধিকৃত করার ক্ষেত্রে যেসব সরকারি সংস্থার ভূমিকা রয়েছে, তার মধ্যে সর্বগ্রে আসবে পুলিশের নাম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় বাহিনী হিসেবে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে গল্পের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়ে নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধিতে মশগুল হয়ে পড়ে এই বাহিনী। আগের মতোই নতুন শাসকদের অধীনেও তাদের আচরণ অপরিবর্তিত রয়েছে, এখনো তারা আইনের অপব্যবহার করে যাচ্ছে।
একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক কর্মী দুই সাংবাদিককে বিমানবন্দর থেকে আটক করে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে সোপর্দ করা হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। যদিও তারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন না—তবুও, আমরা জানতে চাই, কোন আইনটি তারা ভঙ্গ করেছেন? কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হলো? তাদের নাম হত্যা মামলার এফআইআরে ছিল না। 'অজ্ঞাত আসামি'দের স্থলে তাদের নাম যোগ করা হলো। এই 'অজ্ঞাত আসামি'র নামে মামলা এবং সেখানে পরবর্তীতে কারও নাম যোগ করে দেওয়া একটি চর্চা, যা শিগগির বাতিল করা উচিত। তদন্ত চলাকালীন অজ্ঞাত আসামিদের জায়গায় যে কোনো সময়, যে কাউকে পুলিশ অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এই দুই সাংবাদিক ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের বড় সমর্থক হয়ে থাকলেও কোনো প্রচলিত আইন ভঙ্গ করেননি। তাদের সাংবাদিকতার সমালোচনা বা ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের সঙ্গে যোগসাজশের বিস্তারিত উন্মোচন করা যেতে পারতো। কিন্তু আইন ভঙ্গের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই কারাবন্দি করা উচিত নয়।
গণমাধ্যম অফিস বা টেলিভিশন স্টেশন ভাঙচুরের ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়-যার সর্বশেষ উদাহরণ ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়ার অফিসে ভাঙচুর। এসব প্রতিষ্ঠান হয়তো অনৈতিক নীতিমালা মেনে চলেছে, একপাক্ষিক অবস্থান নিয়েছে বা ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সেবায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু জোর করে তাদের কণ্ঠরোধ করে দেওয়া যাবে না। সাংবাদিকতা চর্চায় তারা যতই স্থূল ও অনৈতিক হোক না কেন, প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, তাদের গ্রেপ্তার বা ভয় দেখানো উচিত না।
এ ধরনের পরিস্থিতি সাংবাদিকদের ভীত করছে। তারা ভাবছেন, আমরা আবারও সেই পুরনো পথেই হাঁটছি কি না, যেখানে শুধু ভুক্তভোগীদের পরিচয় বদলেছে-বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের বদলে এখন আওয়ামীপন্থীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। আমরা কোনোভাবেই অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারি না।
তারপর বলতে হয়, আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী দীপু মনির ঘটনাটি। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হামলা থেকে তাকে নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এই ব্যর্থতার দায় পুলিশ এড়াতে পারে না। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বলতে হবে, এসব পক্ষপাতদুষ্ট আইনজীবী তাদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছেন, আদালত ও নিজ পেশার অবমাননা করেছেন।
যেভাবে গণহারে প্রমাণ ছাড়াই সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে, তাতে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। অবস্থাদৃষ্টে 'আগে মামলা পরে প্রমাণ' পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এতো বেশি হত্যা মামলা হচ্ছে যে বিষয়টি জনমনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করছে। এমন মামলা যত বেশি হবে, ততই গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য কয়েকটি যথোপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ সমর্থিত, বস্তুনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ মামলাই যথেষ্ট। কিন্তু যেভাবে বিষয়টি এগোচ্ছে, তাতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা; বিচারক; আইনজীবী; মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবিরদের মতো বুদ্ধিজীবী; সাবেক বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম; হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের (যাকে গতকাল রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে) মতো রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হচ্ছে। কিছু মামলায় ৩০, ৪০, এমনকি ১২০ জনের নাম রয়েছে আসামি হিসেবে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই এসব মামলায় তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। আদালত এই মামলাগুলোকে নথিবদ্ধ করার জন্য স্থানীয় থানায় পাঠায়। তারপর বাছবিচারহীনভাবে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আইনি প্রক্রিয়ার এ ধরনের ব্যবহার ও কোনো প্রমাণ ছাড়া হত্যা মামলা করা আইনের অপব্যবহার, যা কেবল আইনি প্রক্রিয়া ও বর্তমান ব্যবস্থার ওপর জনগণের ভরসা কমাবে।
আগের সরকারের মতোই একইভাবে আইনকে হাতিয়ার বানানোর প্রবণতা আমাদের এই ধারণা দিচ্ছে যে, আগের মতোই এখনো আইনের অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। গ্রেপ্তারকৃত মন্ত্রীরা যেসব অপরাধ করেছেন-ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট অপরাধ, ঘুষ, দুর্নীতি ও ব্যাংকিং খাতে কারসাজি-সেগুলোর বদলে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। প্রতিবার এমন হত্যা মামলা দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়া।
আমাদের আইন উপদেষ্টা এ ধরনের আইন ও চর্চার সমালোচনা করে অনেক লেখালেখি করেছেন। আশা করব, তিনি এভাবে আইনের অপব্যবহার বন্ধ করবেন এবং সার্বিক প্রক্রিয়াকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবেন।
একইসঙ্গে ছাত্র-জনতা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার কিছু ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে এমন কিছু ঘটনা নিয়ে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত। যেমন:
১. জোর করে সচিবালয়ে ঢুকে এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে বাধ্য করা
২. বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় আমলাদের পদোন্নতি দিতে সরকারকে বাধ্য করা
৩. জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন পদ থেকে শিক্ষকদের অপসারণ
৪. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তদের বদলাতে বাধ্য করা
৫. এই ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করার দৃষ্টিকটু তোড়জোড়
উপরের প্রতিটি ঘটনাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর এবং এর ফলে তাদের প্রতি সামান্য হলেও জনগণের আস্থা কমছে। কয়েকটি ঘটনাকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নেওয়া যায়। যখন একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারের হঠাৎ পতন হয়, তখন এক ধরনের ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এই পটপরিবর্তনের সুযোগ নিতে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ও সুযোগসন্ধানী উভয়ই এগিয়ে আসে এবং উপরে বর্ণিত ঘটনার সৃষ্টি হয়। প্রতিদিনই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে অন্তহীন দাবিদাওয়া নিয়ে মানুষ বিক্ষোভ করছেন—যার বেশিরভাগই ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায়, জাতীয় স্বার্থ নয়।
অধ্যাপক ইউনূসের সরকার এখানে এসেছে মানুষের, বিশেষত গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কারণে। তারা শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু আমাদের সামনে বিপদসংকুল পথও রয়েছে। এই পথ বিপদসংকুল হওয়ার কারণ হচ্ছে বিভাজন। আমাদের মাঝেই রয়েছে সাবেক শাসকদের চাটুকার, ক্ষমতালোভী ও সুযোগসন্ধানী মানুষ এবং বিশেষ মহল—যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যহার করেছে এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও ব্যাংকগুলো লুটেছে। তারা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার সরকার পরিচালনা প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার অভাবও আমাদের আগামীর যাত্রা পথকে খানিকটা বন্ধুর করছে। এগুলো সম্মিলিতভাবে আমাদের পথ চলাকে আরও বিপদসংকুল করছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেমনটি বলেছেন, আমরা যেন ভুল পথে হেঁটে এই সুযোগ না হারাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, আমরা ঠিক সেই কাজটিই করছি।