সারা বিশ্ব এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে কী হয়, কী হয়। অর্থাৎ কিনা মিশর সীমান্তবর্তী শহর রাফায় আর্ত, অসুস্থ, ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত যে গাজাবাসীরা আশ্রয় নিয়েছেন, সেই নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ ফিলিস্তিনিদের উপর বিমান ও স্থল আগ্রাসন চালিয়ে কি নৃশংসভাবে হত্যা করে তা দেখার প্রবল আগ্রহ বিশ্বের ‘সভ্য’ মানুষদের। কারণ এখানে হত্যা করা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দাদের, মুসলিমদের, আরবদের, মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কর্তৃক কথিত ‘সভ্যতার সংঘাতে’র অপরপক্ষ ইসলাম অনুসারীদের। আমরা সেইসময় প্রতিবাদ করে বলতাম, ‘সভ্যতার সংঘাত নয়’, বরং চাই সভ্যতাগুলির সহযোগিতা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন-এর কথাটাই যে ছিল নির্মম সত্য, তা এখন মর্মে মর্মে মিলে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইসলাম অনুসারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে সব ক্ষেত্রেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তা সে ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদী আধিপত্য- যাই হোক না কেন।
পশ্চিমারা চিন্তা-চেতনা, গবেষণায় অনেক অগ্রনী। তাই তারা অনেক ভেবেচিন্তে অটোমান বা ওসমানিয় খিলাফতের পতন ঘটিয়েছিল। আরব জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছিল। আর সৃষ্টি করেছিল ইসরাইলের। তারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যায়নবাদী ইহুদীদের এনে অবৈধভাবে তৈরি করে ইসরাইলের। হত্যা, ধ্বংস, বোমা-ডিনামাইট ব্যবহার করে বিতাড়িত করেছিল নিজভূম থেকে অসহায় ফিলিস্তিনিদের। আর এই যায়নবাদী রাষ্ট্রটিকে রক্ষায় তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর ব্যয় করেছে। ইসরাইলের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য তারা শুধু অর্থ নয়, আধুনিক অস্ত্রের সম্ভার দিয়েও সহায়তা করে যাচ্ছে। পশ্চিম এশিয়ায় ইসরাইল এখন পশ্চিমা স্বার্থের পাহারাদার।
প্রতি দিনই মারা যাচ্ছে শত শত ফিলিস্তিনি। এই হলোকাস্ট বা নিধনযজ্ঞ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে। পশ্চিমাদের বক্তব্য, ইসরাইলের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য তাদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর অধিকার রয়েছে।
কিন্তু কী জানি, এই রাষ্ট্রগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী বলে ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘জীবন ও সম্পত্তির অধিকার’, ‘মানবাধিকার’, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’, ‘গণমাধ্যমের আজাদী’- আরও কত কী! কিন্তু ইসরাইলের ক্ষেত্রে এইসব শব্দাবলী প্রযোজ্য নয়। আসলে এটা এখন দিনের মতো স্পষ্ট এইসব শব্দাবলী পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের প্রয়োজনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মাত্র।
ইয়েমেনের হুতিদের সংগঠন আনসারুল্লাহ্ লোহিত সাগরে ইসরাইলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। তাদের বক্তব্য, গাজায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা লোহিত সাগরে আক্রমণ চালিয়ে যাবে। এতে অবশ্য ইসরাইলসহ অনেকেরই বাণিজ্যিক এবং সামরিক স্বার্থের ক্ষতি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ উন্নত ও অত্যাধুনিক মিসাইল এবং বিমান হামলা দ্বারা ইয়েমেনে আরেক হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। ছোট্ট একটি উপসাগরীয় দেশ বাহরাইনও খ্রিস্টান পরাশক্তিগুলির পক্ষ নিয়েছে।
কিন্তু ইসরাইলের কাছে মৌখিক অনুনয়-বিনয় করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। নিরাপত্তা পরিষদে এবং সাধারণ অ্যাসেম্বলিতে পাশ হওয়া সত্বেও বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অনুগত দাস ঋষি সুনকের অনুগত দাস অবক্ষয়-পীড়িত বৃটেন বিন্দুমাত্র দেরি না করে ইয়েমেনের উপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ইসরাইলকে রাফায় আক্রমণ করতে নিষেধ করা কিংবা তা না মানলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার তাদের কোনও ক্ষমতা নেই। ইয়েমেন, ইরাক, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, সিরিয়া- সব জায়গায় তারা খেয়ালখুশি মতো হামলা চালাতে পারে। ধ্বংস করতে পারে পরিকাঠামো এবং শাসন ব্যবস্থা। সৃষ্টি করতে পারে দেশজুড়ে অশান্তি, গোলোযোগ এবং অনিশ্চয়তার। তাই রাফাহ্ এখন জাতিসংঘের কথায় বিষম মানবিক বিপর্যয় ও হত্যাযজ্ঞের অপেক্ষায় রয়েছে।